খাস কলকাতার বুকে এক জন বিশ্বকর্মা ছিলেন। ঈশ্বরের নাম পেয়েছিলেন এক গাড়ি নির্মাতা। তিনি বিপিনবিহারী দাস। প্রায় ৯০ বছর আগে নিজে হাতে গাড়ি তৈরি করে, বালিগঞ্জের রাস্তায় সেই গাড়ি ছুটিয়েছিলেন বিপিনবিহারী। তাঁর মৃত্যুর পরে মিউনিসিপ্যাল গেজেট চোদ্দো লাইনের শোকসংবাদ প্রকাশ করে। ১৯৩৮-এর ৯ এপ্রিল সেই শোকসংবাদে লেখা হয়, ‘এই দেশে তিনিই (বিপিনবিহারী) মোটর গাড়ির একমাত্র ভারতীয় নির্মাতা...।’
একটি ছােট্ট মোটর গ্যারাজ ছিল বিপিনবিহারীর। সেখানেই প্রথম স্বদেশি গাড়ি তৈরি করে সকলকে চমকে দিয়েছিলেন এই বঙ্গসন্তান। গাড়ির নামও ছিল ‘স্বদেশি’। বালিগঞ্জের গ্যারাজ তথা কারখানায় সব মিলিয়ে চারটি গাড়ি তৈরি করেছিলেন তিনি।
প্রথাগত শিক্ষা নেই। স্বদেশি আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় গাড়ি তৈরি করতে এগিয়ে এসেছিলেন বিপিনবিহারী। অনেক বিদ্রুপ জুটেছিল। সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে ১৯৩১ সালে তাঁর হাতেই তৈরি হল প্রথম স্বদেশি গাড়ি। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় গাড়িটি কিনেছিল। মতিলাল নেহরু, মদনমোহন মালব্য-সহ বহু বিশিষ্ট মানুষ সে গাড়ি চড়েছেন।
১৯৩৩ সালে বিপিনবিহারী দ্বিতীয় গাড়িটি তৈরি করেন কলকাতা পুরসভার জন্য। কলকাতা পুরসভার সঙ্গে গাড়ি বানানো নিয়ে চুক্তি হয়েছিল তাঁর। কাউন্সিলর মনোমোহন মুখোপাধ্যায়ের প্রস্তাবে কলকাতা পুরসভার ওয়ার্কস কমিটি পুরসভার জন্য গাড়ি বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। বরাত যায় ১০০ বন্ডেল রোড নিবাসী বিপিনবিহারীর কাছে। ১৫ হর্স পাওয়ারের, ৫টি আসন বিশিষ্ট, চার দরজাওয়ালা টুরিট মডেলের মোটরগাড়ির মূল্য হিসাবে বিপিনবিহারী ৩,০০০ টাকা দাবি করেন। গাড়ি তৈরির জন্য ছয় মাস সময় দেওয়া হয়। প্রতি মাসে ৩০০ টাকা করে এবং কাজের শেষে বাকি ১২০০ টাকা দেওয়ার কথাও চুক্তিতে লেখা হয়েছিল। পুরসভা কর্তৃপক্ষ ২ বছরের গ্যারান্টিও চেয়েছিলেন। ১৯৩২ সালের ১৯ মার্চ ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল গেজেটে এই চুক্তির খবর বেরিয়েছিল। গাড়ি নির্মাণ শেষ হয় পরের বছর, ১৯৩৩ সালে। গাড়িটির নম্বর ছিল ৩৯৫৭৭। আর একটি গাড়ি বিপিনবিহারী বানিয়েছিলেন গ্বালিয়রের রাজার জন্য।
ভারতের মাটিতে নিজস্ব প্রযুক্তিতে মোটরগাড়ির নির্মাণের প্রাণপুরুষ ছিলেন বিপিনবিহারী দাস। প্রতিদানে ভালবেসে, তাঁর কাজের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কলকাতা তাঁর নাম রেখেছিল ‘বিশ্বকর্মা’।
তথ্যঋণ:
কলের শহর কলকাতা, সিদ্ধার্থ ঘোষ
পুরশ্রী পত্রিকা (ফেব্রুয়ারি, ২০১২)
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।