মা দুর্গা কোথাও লৌকিক রূপে, কোথাও স্বপ্নাদিষ্ট কল্যাণী বরদাভয়দায়িনী রূপে বর্তমান। এ তাবড় বঙ্গদেশ তাঁর লীলাক্ষেত্র। শাড়ির আঁচলে বাঁধা স্নেহ ছড়িয়ে রেখেছেন আমাদের পথে-ঘাটে-বাটে। বিবিধ তিথিতে বিবিধ প্রকরণে তাঁর পুজো হয় বটে, কিন্তু আদতে মা সেই একই আদিশক্তি।
হাওড়ার ছোট্ট জনপদ জগৎবল্লভপুর। প্রাচীন ভূরশুট পরগণার কাছে ছোট্ট একখানা তালুক। জমিদার রানি ভবানীর এক উত্তর পুরুষ। মা স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠা নিলেন সিংহবাহিনী অষ্টভুজা রূপে। এ যেন মায়ের কুষ্মাণ্ডা রূপেরই ভিন্ন প্রকাশ।
রূপ: মা শ্বেত সিংহারূঢ়া, অষ্টভুজা কাঞ্চনবর্ণা, হাস্যময়ী, কল্যাণী। ডান পার্শ্বের তিনটি হস্তে অসি,বাণ ও পাশ। বাম পার্শ্বে ঢাল, ধনুর্বাণ ও শঙ্খ। বাম ও ডান হাত দু’টি মিলিত শাশ্বত বরাভয়মুদ্রা জোড়ে।
পশ্চাদপটের চালচিত্রের মাথায় নন্দীকেশ্বর মহাদেব, দশমহাবিদ্যা ও দশাবতার বিষ্ণু অঙ্কিত আছেন। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্য হল এ প্রাচীন মূর্তি দারু অর্থাৎ কাষ্ঠ নির্মিত। আদ্যোপান্ত নিম কাষ্ঠ দ্বারা এ মূর্তি তৈরি। আর এখানেই লুকিয়ে আছে সেই স্বপ্নাদেশের কথা।
প্রাচীন কথা: আনুমানিক পাঁচশো বছর পূর্বে এই অঞ্চলে মণিরাম চক্রবর্তীর ভদ্রাসন ছিল। চক্রবর্তী মশাই গৃহী-সাধক। গৃহ পার্শ্ববর্তী এক নিম গাছের তলায় সাধনায় বসতেন।
এক সন্ধ্যায় জপ-আহ্নিক সেরে সাধনায় বসেছেন। সালংকারা এক কিশোরী এসে ব্রাহ্মণের সাধন ভঙ্গ করলেন। কন্যাটি আপন পরিচয় দিল, বর্ধমানরাজ কৃষ্ণ রায় দুহিতা বলে! নায়েবের সঙ্গে বাবার জমিদারি দেখতে এসেছে! এই কথা বলে সেই কন্যা সেই বৃক্ষতলেই বসে পড়ল।
এমন কথা ব্রাহ্মণ কখনও শোনেননি। তড়িঘড়ি তাঁর স্ত্রীকে ডাকতে গেলেন। ফিরে এসে দেখেন, সেই কন্যা নেই! ব্রাহ্মণ অবাক হলেন, এ ছোট্ট জনপদে রাজ দুহিতা এলে যে দারুণ ব্যাপার! কিন্তু তেমন সোরগোল কই! কেউ তো খুঁজতেও এলেন না। আর সেই কন্যাই বা গেলেন কোথায়!
সেই রাতেই জমিদারের স্বপ্নে মা সিংহবাহিনী দেখা দিলেন। তিনি স্বয়ং মুকুন্দরামের ডাকে এসেছিলেন। তাঁর সাধনস্থলে স্থিতি না দিয়ে পারেননি। ওই নিমবৃক্ষ দিয়েই হবে তাঁর গৌরী মূর্তি। কারণ জমিদারকন্যা গৌরীর রূপেই তিনি এসেছিলেন।
৩৬৫ বিঘা দেবোত্তর সম্পত্তি দান করে, রাজা মন্দির নির্মাণ করলেন। মুকুন্দরাম চক্রবর্তী হলেন সেবায়েত। নিত্যদিন অন্নভোগে সেবিত হতে লাগলেন মা সিংহবাহিনী। সীতা নবমীর পুণ্যতিথিতে মায়ের বাৎসরিক পুজো ও অন্নকূট উৎসব পালিত হয়। সাড়ম্বরে পালিত হয় মেলা।
যুগান্তর ঘটে গিয়েছে কিন্তু আজও কল্যাণীর স্নেহাঞ্চলে ঢাকা পড়ে জগৎবল্লভপুর। সাধে কী আর রামপ্রসাদ বলে গিয়েছেন, ‘ত্রিলোচন যার পাইনি তত্ত্ব / আমি তার অন্ত পাব কী’
তথ্যসূত্র:
- লোক সমীক্ষা
- বিভিন্ন আর্টিকেল
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।