Advertisement
Panchamundi Asan

নবদ্বীপের অদূরে মেড়তলা! তন্ত্রসাধনা ও ঐতিহাসিক গল্পের আকর

নবদ্বীপের কাছে মেড়তলার ইতিহাসে নিয়ে রাজপরিবারের কাহিনি, এত তন্ত্রসাধনার গল্প মিলে আছে, শুনলে কী যে আশ্চর্য লাগে!

রাজা পোদ্দার
শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:৪৪
Share: Save:

নবাব আলিবর্দি খানের দৌহিত্রী মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সুদর্শন পুত্রকে দর্শন মাত্র প্রেমে পড়েছিলেন! দাদু আলিবর্দি খাঁনকে গিয়ে ধরলেন আদরের নাতনি। বিয়ে যদি করতেই হয় তো এঁকেই করবেন।

নবাব ডেকে পাঠালেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে। প্রস্তাব দিলেন বিবাহের। প্রস্তাব শুনে মাথায় বাজ পড়ল কৃষ্ণচন্দ্রের। এক মুসলিম নারীকে পুত্রবধূ করলে সমাজ তো একঘরে করে ছাড়বে।

দ্বারস্থ হলেন শ্রী শ্রী কালীশঙ্কর ঠাকুরের কাছে। মেড়তলার তন্ত্রসাধক কালীশঙ্করের তখন চার দিকে নামডাক। আশেপাশের দশ-বিশটা গ্রামের মানুষ তাঁকে মান্যি করেন, ভয় পান। এই কালীশঙ্কর নাকি তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ করে নবাবের দৌহিত্রী এবং রাজপুত্র দুজনকেই রোগগ্রস্ত করে তোলেন।

স্থগিত হয়ে যায় বিবাহ। পরে তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপে কৃষ্ণচন্দ্রের পুত্র সুস্থ হয়ে উঠলেও মারা যান নবাবের দৌহিত্রী। কল্প-কাহিনি হলেও মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন প্রবল ভাবে শাক্ত। কালীসাধনায় তাঁর অপার ভক্তি, নিষ্ঠা।

মেড়তলার প্রবল প্রতাপান্বিত কালীশঙ্কর নিয়ে প্রচুর মিথ ছড়িয়ে আছে। কিন্তু কে এই কালীশঙ্কর? মেড়তলাই বা কোথায়?

কৃত্তিবাস রামায়ণে রয়েছে মেড়তলার স্থানমাহাত্ম। কৃত্তিবাসী রামায়ণে গঙ্গাবতরণের বর্ণনায় আছে, “চলিলেন গঙ্গামাতা করি বড় ত্বরা।/ মেড়তলা নাম স্থানে যায় সরি দ্বরা।/ মেড়ায় (ভেলায়) চড়িয়া বৃদ্ধ আইল ব্রাহ্মণ/মেড়তলা বলি নাম এই সে কারণ।।”

গঙ্গার পশ্চিম কুল মেড়তলা গ্রাম। /যাদুয়া বিরাজ তথা তুল্য কাশীধাম।/সিদ্ধবংশ শিব অংশ গোস্বামীর বাস।/ অন্তে গঙ্গাপাই যেন এই অভিলাষ।নবদ্বীপ শহরের অদূরে এই মেড়তলা একদা ছিল জমজমাট গঞ্জ।

সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্বে মহাপ্রভু নবদ্বীপ থেকে কাটোয়া এই মেড়তলা হয়ে যেতেন। একদা গৌড় বঙ্গ, ওড়িশি বা কাশীধাম থেকে বিভিন্ন বিদ্যার্থী নবদ্বীপে আসতেন বিদ্যা লাভের জন্য।

সংস্কৃতে বুৎপত্তি লাভের জন্য সে রকম নবদ্বীপে এসেছিলেন রাজারাম তর্কবাগীশ। কথিত, সংস্কৃত শিক্ষালাভ সমাপ্তে রাজারাম দেশ- দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো কালে এক সিদ্ধপুরুষের সাক্ষাৎ পান। সেই সিদ্ধপুরুষের কাছ থেকেই তিনি তিনি যদুয়া মাতাকে লাভ করেছিলেন।

ক্রমে যদুয়া মাতাই হয়ে উঠেছিলেন রাজারামের আরাধ্য। তিনিই যদুয়া মাতাকে নবদ্বীপের অদূরে এই মেড়তলায় প্রতিষ্ঠা করলেন।অত্যন্ত গোপন ছিল এই সাধনা এবং পুজোপাঠ। তন্ত্রের ভাষায় এই সাধনাকে বলা হত, 'গোপয়েৎ মাতৃজারবৎ'।

ক্রমে ক্রমে শাক্ত চর্চায় এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে উঠল প্রাচীন জনপদ এই মেড়তলা।মেড়তলা ছিল বাংলায় শাক্ত এবং তন্ত্রচর্চায় একবারে শুরুর দিকের পীঠস্থান। রাজারামের পুত্র ছিলেন কালীশঙ্কর। কালীশঙ্করও ছিলেন সংস্কৃতে শাস্ত্রে অগাধ পণ্ডিত।

আগমবাগীশের তন্ত্রশাস্ত্রে বুৎপত্তি লাভ করেন কালীশঙ্কর। তিনিও আগমপদ্ধিতেই তন্ত্রসাধনায় রত ছিলেন। আর এক সুহৃদ রামহরি ঠাকুরের সঙ্গে এই মেড়তলাতে তিনি একাধিক চতুষ্পাঠী খুলেছিলেন।

ক্রমেই তন্ত্রশাস্ত্রের আখড়া হয়ে উঠল মেড়তলা। দিনে বিভিন্ন টোলে অধ্যয়ন আর নিশীথ রাত্রে জগদম্বা যাদুয়া মাতার বিশেষ পুজো। এত গোপনীয় ছিল সে পুজো যে, সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ ছিল রাত্রিকালে। সারারাত ব্যাপি পুজো পাঠের পর, পর দিন সকালে আবার অধ্যয়ন। কেবল তন্ত্রসাধনা নয়, তন্ত্রশ্রাস্তের পাঠ- অধ্যয়ন- অধ্যপনা চলত এই মেড়তলায়। এই স্থানেই চরম সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন কালীশঙ্কর।

বিভিন্ন সময় গঙ্গার প্রবল ভাঙনে, বন্যায় নবদ্বীপ এবং তৎসংলগ্ন একাধিক এলকা গঙ্গাগর্ভে বিলীন হলেও স্থানীয় লোকেদের বিশ্বাস কেবল মাত্র যাদুয়া মতার সাধনস্থল বলেই গঙ্গা কখনও ছুঁতে পারেনি এই সামধী ক্ষেত্র। সময়ের সরণিতে মেড়তলার নাম ফিকে হয়ে এলেও আজও রয়ে গিয়েছে পঞ্চমুণ্ডি আসনের সেই সমাধিক্ষেত্র।

এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kali Puja 2023 Nabadwip
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE