কলকাতার দক্ষিণেশ্বর মন্দির। চলতি বছরের এই মন্দিরের কালীপুজো ১৬৯ বছরে পড়ছে।
লক্ষ লক্ষ ভক্ত সমাগমের এই পবিত্র পীঠ আজও সগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে বহমান সময়ের সাক্ষী হয়ে। দক্ষিণেশ্বরের এই পূণ্যভূমি ঘিরে কত কত জানা-অজানা গল্প!
বর্তমানে দক্ষিণেশ্বর মন্দির কমিটির সম্পাদক ও ট্রাস্টি কুশল চৌধুরীর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এল এমনই সব ঐতিহাসিক কাহিনির উচ্চারণ!
প্রথমেই জানতে চাইব, দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রাঙ্গণে মূল মন্দিরের পাশাপাশি ৯ টি মন্দির। এর শাস্ত্রীয় বা ধর্মীয় ব্যাখ্যা ঠিক কী?
দেখুন, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে শাক্ত, বৈষ্ণব ও শৈব, তিন ধারার পুজোই এক সঙ্গে ঘটে, যা আর কোথাও দেখা যায় না। এই ত্রিবেণী সঙ্গম ঘিরে আজও একই প্রাঙ্গণে দেবী কালীর পুজো হয়ে শাক্ত মতে, বৈষ্ণব মতে রাধাকৃষ্ণের পুজো। আর ১২ টি শিবমন্দিরে হয় শৈব ধারার শিব আরাধনা।
আচ্ছা। আর এই আশ্চর্য স্থাপত্যের পিছনে ভাবনাটি কী ভাবে এল?
আসলে, এই মন্দির তো কেবল ধর্মীয় স্থান হিসেবে বিখ্যাত নয়, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে অতীব গুরুত্বপপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা সব জড়িয়ে। এই মন্দির সাক্ষী স্বাধীনতা সংগ্রাম, বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মতো ঘটনার! সহজ ভাবে বলতে গেলে, এই ত্রিবেণী সঙ্গমের উদ্দেশ্যই ছিল সমাজের সকল বিশ্বাসের মানুষকে মতভেদের ঊর্ধ্বে উঠিয়ে এক সঙ্গে নিয়ে আসা।
সকলেই জানেন, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে দেবী কালী ভবতারিণী রূপে পূজিতা হন। কিন্তু কেন, সেই গল্পটা যদি…
মন্দিরের ইতিহাসের নানা পুঁথিপত্র যদি প্রমাণস্বরূপ দেখা হয় বা শাস্ত্রীয় গ্রন্থেও খুঁজলে দেখা যাবে, ভবতারিণীরূপে দেবীর পুজোর প্রচলনের কথা আদৌ কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। ১৮৫৫ সালের ৩১ মে, স্নান যাত্রার দিনে এই মন্দিরে হিন্দু শাস্ত্রের রীতিনীতি একাগ্রভাবে মেনে পন্ডিত রামকুমার চট্টপাধ্যায় মায়ের বিগ্রহে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই দেবীর নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে শ্রী শ্রী জগদীশ্বরী কালীমাতা ঠাকুরানী, অথচ ভবতারিণী দেবীর কোনও উল্লেখই নেই! বিষয়টি বেশ ধোঁয়াশা বোধ হলেও, এর ব্যাখ্যা হিসেবে এক মাত্র বলা যায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভবতারিণী রূপের কথা লোকমুখে প্রচলিত হয়ে যায়। শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজে যেহেতু দেবীকে ভবতারিণী মানতেন, সেই জেরেই। তবে এখনও এই দেবালয়ের সকল আমন্ত্রণ পত্রে থাকে ‘শ্রী শ্রী জগদীশ্বরী কালীমাতা ঠাকুরানী জয়তু’।
রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বেশ কিছু বছর ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন এই পুজোর সঙ্গে। তাঁর সময়ের পুজো কেমন ছিল, এই কথা কি জানা যায়?
১৮৫৫-৫৬ সালের দিকে পণ্ডিত রামকুমার চট্টোপাধ্যায় যখন অসুস্থ হয়ে পড়েন, পুজোর কাজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। তাঁর আগে ঠাকুর রাঁধা-কৃষ্ণ মন্দিরে সহকারী হিসেবে পুজোর দায়িত্বে ছিলেন তিনি এবং সমাধিস্থ অবস্থায় উত্তীর্ণ হওয়ার আগে পর্যন্ত নিজে হাতে মায়ের পুজো করে গিয়েছেন তিনিই। তবে তাঁর ধারা ছিল একদম অন্য রকম। শুধু শাস্ত্র বা পুঁথির মতে না গিয়ে, তিনি নিজের পথে ও মতে মায়ের পুজো করতেন।
এই অন্য কোনও গল্প বলতে পারেন?
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে আজও তাঁর নির্দেশিত পথে পুজো হয়ে চলেছে। কালীপুজোতে শাস্ত্র মতে 'কারণ'য়ের ব্যবহার করতেই হয়, তবে এখানে তা হয় না। কথিত, এক দিন সন্ধ্যারতির শেষে ঠাকুর পুজোয় বসেছেন, এবং তাঁর সহকারী সব সামগ্রী এগিয়ে দিচ্ছেন। সঙ্গে রয়েছে কারণের পাত্রটিও। হঠাৎই ঠাকুর ইতিউতি দেখে ইশারা করেন একটি ঝুনো নারকেলের দিকে! ঠাকুর সেই নারকেল ভেঙে তার জল স্থাপিত ঘটের উপর ঢালেন। বলেন সেটাই নাকি কারণ। সেই মুহূর্ত থেকে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে কারণ ব্যবহার বন্ধ, নারকেলের জল ঢেলেই আজও পুজো হয় এখানে, যা এই মন্দিরের পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের গর্ভগৃহে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। তবে ব্যবহারিক জীবনে গর্ভগৃহে কোন কোন আচার ও রীতি মেনে চলা হয়, তা যদি বলেন!
প্রথমেই বলি, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের গর্ভগৃহ একটি অত্যন্ত সুরক্ষিত স্থান। এর পিছনে দু'টি কারণ রয়েছে, প্রথমত, মন্দিরে দেবীর বিগ্রহকে পুরোহিত ছাড়া কেউ স্পর্শ করতে পারেন না। অন্য কারও স্পর্শ করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। দ্বিতীয়ত, গর্ভগৃহে আসা যাওয়া ভীষণ সংরক্ষিত। উত্তরসূরী হিসেবে আমি নিজে বিশ্বাস করি, যে স্থলে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব, স্বামীজি, আরও বহু সাধক, মহাত্মারা গিয়েছেন, নিত্যপুজো করেছেন, একাগ্র প্রার্থনা জানিয়েছেন, সেই জায়গায় সকলে না গেলেই বরং ভাল!
হুম!
ঘটনা হল, ঠাকুরের সঙ্গে মায়ের এখানে আধ্যাত্মিক বলয় গড়ে উঠেছে, এমনকি জ্যোতির্দশন হয়েছে, এই দেবস্থানের অন্দরমহলে এখনও দেওয়ালের প্রতিটি কোণায় ধরা রয়েছে সেই দৈবিক শক্তি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কারও গর্ভগৃহে প্রবেশ অনুচিত। শুদ্ধ বসন ও শুদ্ধ চিত্ত নিয়ে কিছু মানামানি তো থেকেই যায় এবং সকলের আসা যাওয়া বেড়ে গেলে আধ্যাত্মিক পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়। তা ছাড়া, দুঃখের বিষয় হল আজকাল সব সুযোগেরই বড় অপব্যবহার করা হয়। কথিত, এক সাধক বলেছিলেন, “আমি গর্ভগৃহে প্রবেশ করব, সেই ভেবে ছয় মাস ধরে নিজেকে প্রস্তুত করছি”, এই ভাবনাকে আমরা মেনে চলি সবাই। সেখানে গেলেই যে আমি মায়ের প্রথম শ্রেনির ভক্ত হিসেবে গণিত হব তা'ও নয়।
পুজোর দিনে গর্ভগৃহে কি আচার রীতিতে কোনও বিশেষ বদল আসে?
অবশ্যই! সেই দিন আরও সংরক্ষিত রাখা হয় স্থলটিকে। ২৪ ফুট বাই ২৪ ফুট একটি ঘরেই মায়ের বিগ্রহ থাকে, যার ৮ ফুট বাই ৮ ফুট স্থান জুড়ে রয়েছে দেবীর সিংহাসন। মাত্র ৪ ফুটের যেটুকু জায়গা বেঁচে থাকে, তার মধ্যেই পুজোর সমগ্র উপকরণ, উপাচার, ঘট স্থাপন সব কিছুই হয়। তার মধ্যে যদি জনগণের ঢল প্রবেশ করতে চায়, তা হলে পুজোয় ব্যাঘাত ঘটতে কতক্ষণ! আমরা এই বিষয়ে তাই একটু বেশিই সচেতন থাকি।
দেখতে দেখতে প্রায় দুই শতাব্দী ছুঁয়ে ফেলতে চলেছে এই মন্দিরের পুজো। কোনও পরিবর্তন কী এসেছে পুজোর ধারায়?
একেবারেই না! পরিবর্তন করতে আমরা পারি না, আমাদের সেই অধিকার নেই, আমরা কঠোরভাবে অনুগামী মাত্র। ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণদেব যে ভাবে চার প্রহরে নিত্য মহা পুজো করতেন, ন্যাস থেকে পুষ্পাঞ্জলি পর্যন্ত, সবটাই এক ভাবে হয়ে আসছে বছর বছর ধরে।
তাও, সময়ের সঙ্গে কোনও আধুনিক বদল কী আসেনি?
বদল এসেছে। পুজোর নিয়মে নয়, তবে ধারার একটি অংশে। এই যে পুরোহিতমশাই সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে চার প্রহরের মহা পুজো করছেন, আমরা সাধারণ মানুষ তার কতটুকুই বা বুঝতে পারি। এক ধাপ থেকে আরেক ধাপে কী ভাবে এগিয়ে চলেছেন পুজোর সময়, তা আদৌ কতটুকু ঠিক বা ভুল বোঝা খুবই শক্ত। তাই আমি যেটুকু পরিবর্তন এনেছি তা হল, অগণিত ভক্তদের দিকে চেয়ে পুরোহিতমশাই যখন সংস্কৃতে মন্ত্রোচ্চারণ করবেন তার পরেই তাঁকে সাদামাঠা বাংলা ভাষায় তার অনুবাদ করে দিতে হবে, এই ব্যাপারটি এনেছি। মন্ত্র কী, কেন, কোন অংশে ব্যবহার হচ্ছে, হোম কী, কেন পুরোটাই মানুষের সুবিধার্থে সহজ বাংলায় বলবেন তিনি। এতে মানুষের ভক্তি, একাগ্রতা সবটাই অর্থ, শ্রেনি ও সমাজের সব অংশ নির্বিশেষে খুব সহজ ভাবে স্পষ্ট হয়।
কত বছর ধরে শুরু হয়েছে এই নতুন বদল?
প্রায় বছর তিনেক হতে চলল। সাধারণ মানুষের থেকে আমরা ভাবনার বাইরে সাড়া পেয়েছি এই উদ্যোগে।
পুজোর কি কোনও বিশেষ শুভযোগ রয়েছে এই বছর?
মহাযোগ উপস্থিত না হলে পুজো হয় না, কালীপুজোর যোগ নিজেই মহাযোগ। শুদ্ধ চিত্তে পুজো দিলে পুরো সময়ই শুভ যোগ বিরাজ করবে। আমরা এমনটাই বিশ্বাস করে থাকি। বছরের পর বছর ধরে এই বিশ্বাস অবলম্বন করেই এখানে মায়ের আরাধনা করা হয়। ভক্ত সমাগম হয়।
সাক্ষাৎকার: শ্রেষ্ঠা মুখোপাধ্যায়
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy