এ বছর ৭৫ বছরে পা রাখল চন্দননগরের স্বাধীনতা। যে বছর দেশের এই শহরটি ফরাসি শাসনের মায়া কাটিয়ে নিজস্বতার পথে হাঁটল, তার ঠিক ২৫ বছর আগে, ১৯৫০ সালে, জন্ম নিয়েছিল এক মহৎ অঙ্গীকার। সেই অঙ্গীকারেরই প্রতিচ্ছবি বেশোহাটা সর্বজনীন জগদ্ধাত্রী পুজোয়।
গোন্দলপাড়া জুট মিলের কর্মী এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সম্মিলিত উদ্যোগে যাত্রা শুরু। শুরুর দিনগুলি ছিল নিতান্তই সাদামাটা— কুমোরটুলি থেকে প্রতিমা আনা হতো। সেই প্রতিমার প্রথম সজ্জা করেছিলেন আদিত্য মালাকার। সময়ের স্রোতে বেশোহাটা শুধু পুজো করেনি, তৈরি করেছে ঐতিহ্য। রাস্তার ধারে শুরু হওয়া সেই উৎসব আজ পেয়েছে নিজস্ব মন্দির প্রাঙ্গণ। বছরের পর বছর ধরে প্রাচীন প্রথাকে ধরে রেখেছে তারা, সঙ্গে মিশেছে আধুনিকতার ছোঁয়া।
বেশোহাটার কথা উঠলে একটি বছর আজও ঝলমল করে ওঠে। সালটা ছিল ১৯৭৪। প্যান্ডেলে সে বছর আলো দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী ক্ষুদিরামের জীবনগাথা। সেই আলোর কারসাজি সে সময়ে শহর জুড়ে আলোড়ন তুলেছিল, যা কার্যত থিম-পুজোর এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। এই ঐতিহ্যই তাদের পরিচয়: নতুন ভাবনা আর ঐতিহ্যের মিশেল।
এখানকার জগদ্ধাত্রী প্রতিমা এক লহমায় নজর কেড়ে নেয়। উচ্চতায় তিনি প্রায় মূর্তিমতী শক্তি। ‘বিরাট তাঁর উচ্চতা, শ্রেষ্ঠ তাঁর ভক্তি’— এই মন্ত্রেই যেন বাঁধা বেশোহাটার আয়োজন। শিল্পীর নিপুণ হাতে গড়া প্রতিমা, অমর পাল এবং ভোলানাথ রায়ের দক্ষ কারিগরির ছাপ, আর তাতে আদিত্য মালাকারের প্রথম কাজের উত্তরাধিকার— সব মিলিয়ে এক অসাধারণ শিল্পকলা। মণ্ডপ শিল্পী সুরজিৎ ও শুভজিৎ এবং সজ্জাশিল্পী শুভব্রত সাহা প্রতি বছর তাঁদের সৃজনশীলতা দিয়ে পুজোকে নতুন মাত্রা দেন। আলোর খেলার দায়িত্ব থাকে তারক পালের হাতে।
উৎসব শুধু আরাধনা নয়, তা মানব জীবনের অঙ্গ। সেই কারণেই বেশোহাটা কেবল পুজোপার্বণে আবদ্ধ থাকেনি। সারা বছর ধরে রক্তদান শিবির ও দুঃস্থদের পাশে দাঁড়ানোর মতো সামাজিক কাজ করে তারা প্রমাণ করেছে ঈশ্বরের সেবা মানবতার সেবা।
আরও পড়ুন:
এ বছর, ২০২৫-এ, বেশোহাটার ভাবনা সেই পুরনো দিনের চন্দননগরকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা। ‘৭৬ এর মা ৭৫-এর দেশে, এ শহর সে সময়ে…’— এই থিমের হাত ধরে পুরনো চন্দননগরের সঙ্গে দেবীর আগমনকে এক সুতোয় গাঁথা হয়েছে। সেই নস্টালজিয়া, সেই রসবোধ, আর গল্পের ছন্দে মানুষী আবেগ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এ বারের আয়োজনে। পুরনো দিনের টুকরোগুলি সেই পথেই যেন আবারও প্রাণ পাবে গঙ্গার ধারের এই শহরে।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।