দুর্গাপুজো বা কালীপুজোর মতো জগদ্ধাত্রী পুজোতেও বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নানা বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। সেই ঐতিহ্যের মধ্যে এমন কিছু প্রথা রয়েছে, যা সত্যিই নজর কাড়া! হুগলির ভদ্রেশ্বরের তেঁতুলতলা বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পুজো তেমনই এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বহন করে চলেছে। স্থানীয়দের কাছে 'বুড়ি মা' নামে পরিচিত এই দেবীকে আজও শতাব্দী প্রাচীন এক রীতি মেনে বরণ করা হয়। যেখানে মহিলারা নন, পুরুষরাই শাড়ি পরে 'এয়ো স্ত্রী'-র বেশে মায়ের বরণ করেন!
২০০ বছরেরও অধিক প্রাচীন এক ঐতিহ্য:
ভদ্রেশ্বরের তেঁতুলতলা জগদ্ধাত্রী পুজো এই বছর ২৩৩তম বর্ষে পদার্পণ করেছে। এটি এই অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন এবং জনপ্রিয় পুজো। জনশ্রুতি অনুযায়ী, এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাম। তাঁর দেওয়ান দাতারাম শূর এই অঞ্চলে এক সময় জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেন। পরবর্তীতে সেই পারিবারিক পুজোই বারোয়ারি পুজোর রূপ নেয় এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে 'বুড়ি মা' হিসাবে দেবীর পুজো হতে থাকে।
পুরুষদের শাড়ি পরে বরণের ঐতিহাসিক কারণ:
এই পুজোর প্রধান বিশেষত্ব হল, দশমীর দিন প্রতিমা নিরঞ্জনের আগে পুরুষদের দ্বারা দেবীবরণের প্রথা! এই রীতি ২০০ বছরেরও বেশি পুরোনো এবং এর পিছনে রয়েছে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। যথা -
আরও পড়ুন:
ব্রিটিশ আমলে নারীর নিরাপত্তা: জনশ্রুতি অনুযায়ী, ব্রিটিশ (ইংরেজ) ও ফরাসিদের সেনা ছাউনি থাকার কারণে এক সময় ভদ্রেশ্বরের গৌরহাটি এলাকায় মহিলাদের বাড়ির বাইরে বেরোনো বা জনসমক্ষে আসা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে ছিল।
কর্তব্য পালনের দায়িত্ব: সেই প্রেক্ষাপটে মহিলারা পুজো বা বরণের দায়িত্ব পালন করতে না পারায়, এলাকার পুরুষরাই মহিলাদের মতো শাড়ি, শাঁখা, সিঁদুর পরে ও মাথায় ঘোমটা টেনে মাকে বরণের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন।
প্রথা আজও বহমান: সেই থেকে আজও এই প্রথা নিষ্ঠা ভরে পালন করা হয়। দশমীর দিন এখানকার পুরুষরা বিবাহিত নারীর বেশে সজ্জিত হয়ে বরণ ডালা হাতে মাকে কনকাঞ্জলি দেন এবং বিদায় জানান। কপালে সিঁদুরের টিপ এবং ঘোমটা মাথায় এই পুরুষদের মাকে বরণ করার দৃশ্য এই পুজোর এক অনন্য আকর্ষণ।
কৃষ্ণনগরের 'বুড়ি মা' ও ভদ্রেশ্বরের 'বুড়ি মা':
'বুড়ি মা' রূপে দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজোর কথা শুনলে অনেকের মনেই কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত 'বুড়ি মা'-এর পুজোর কথা এলেও, ভদ্রেশ্বরের তেঁতুলতলার এই জগদ্ধাত্রীও প্রাচীনত্বের দিক দিয়ে অন্যতম। স্থানীয়দের কাছে এই পুজোও সমান ভাবে আবেগ ও ভক্তির প্রতীক। উভয় ক্ষেত্রেই 'বুড়ি মা' শব্দটি দেবীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও প্রাচীনত্বের পরিচয় বহন করে।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।