তিনি তো দেবী দুর্গাই রূপ। যতটা সাড়ম্বরে দেবী দুর্গার আরাধনা করা হয়, দেবী জগদ্ধাত্রীকে ততটাই সাদরে বরণ করা হয় বেশ কিছু জায়গায়। চন্দননগর, কৃষ্ণনগর তো আছেই, বলা হয়, শান্তিপুরেই নাকি প্রথম শুরু হয় বাংলার জগদ্ধাত্রী পুজো। পুরাণ বলে, নদীয়ার শান্তিপুরে হরিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের ব্রহ্মশাসনে ধ্যানে বসে চন্দ্রচূড় তর্কচূড়ামণি জগদ্ধাত্রী পুজোর পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। সেই থেকেই শুরু… বাংলার এক এক জায়গায় জগদ্ধাত্রী আরাধনার কিছু নজির আলোচনা করা হল। প্রথম শুরু করা যাক শান্তিপুরের চন্দ্রচূড় তর্কচূড়ামণির পুজো থেকেই।
শান্তিপুরের ব্রহ্মশাসন জগদ্ধাত্রী পুজো- নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র গিরিশচন্দ্র রায় এক সময়ে শান্তিপুরের ব্রহ্মশাসন গ্রামে ১০৮ জন ব্রাহ্মণকে বসবাসের জায়গা করে দেন। সেই থেকেই জায়গাটির নাম ব্রহ্মশাসন। এদেরই এক জন ছিলেন তর্কচূড়ামণি। তিনি তাঁর সাধনায় দেখা পেয়েছিলেন জগদ্ধাত্রী দেবীর। কথিত, সেই সাধনাতেই পুজোর পদ্ধতি এবং মন্ত্রের হদিস পেয়েছিলেন তিনি। পরে সেই পদ্ধতি অনুসরণ করেই নাকি জগদ্ধাত্রী পুজো হয়ে আসছে সর্বত্র।
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো- সেই সময়ে বাংলার ক্ষমতায় ছিলেন নবাব আলিবর্দি খাঁ। তাঁর রাজত্বে মহারাজার কাছ থেকে ১২ লক্ষ টাকা নজরানা দাবি করা হয়। কিন্তু রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তা দিতে অস্বীকার করলে তাঁকে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয় মুর্শিদাবাদ। তিনি যখন ছাড়া পান, তত দিনে দুর্গাপুজোর বিসর্জনের বাজনা বেজে গিয়েছে। সেই বছর দুর্গাপুজো করতে না পারায় অত্যন্ত দুঃখ পান তিনি। কথিত, সেই রাতেই রাজার স্বপ্নে এসেছিলেন দেবী জগদ্ধাত্রী। নির্দেশ দিয়েছিলেন, ঠিক দুর্গাপুজোর মতো করেই বিধি মেনে জগদ্ধাত্রী আরাধনা করতে। সেই থেকে কৃষ্ণনগরে শুরু হয় দেবীর আরাধনা। জানা যায়, পরবর্তী কালে কৃষ্ণচন্দ্রের পুজোয় অনুপ্রাণিত হয়ে ফরাসিদের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী শুরু করেন চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো।
আরও পড়ুন:
সাবর্ণদের জগদ্ধাত্রী পুজো- রায় চৌধুরী পরিবারে দীর্ঘ দিন ধরে জগদ্ধাত্রী পূজিত হয়ে আসছেন সাড়ম্বরে। এই বাড়িতে দেবীর গায়ের রং নাকি শিউলির বৃন্তের মতো হয়। বেনারসী শাড়ি এবং প্রাচীন গয়নায় সাজানো হয় দেবীকে। শুক্ল পক্ষের নবমীর দিনই পুজো হয় বড়িশার আটচালায়।
কলকাতার পাল বাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো- বটকৃষ্ণ পাল ১৮৯৩ সালে উত্তর কলকাতায় ৭৭ বোনিয়াটোলা স্ট্রিটে জমি কিনে বসতবাড়ি নির্মাণ করেন এবং সেই বাড়িতেই প্রতিষ্ঠা করেন একটি অত্যন্ত সুন্দর কারুকার্যখচিত ঠাকুরদালান। সেখানেই মহাসমারোহে শুরু হয় জগদ্ধাত্রী পুজো।
ছাতু বাবু এবং লাটু বাবুর জগদ্ধাত্রী পুজো- এই বাড়ির দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজো প্রায় ২০০ বছরেরও পুরনো। ১৮৭০ সালে বংশের পূর্বপুরুষ রামদুলাল দে শুরু করেছিলেন এই পুজো। নবমীর দিনেই পুজো অনুষ্ঠিত হয়, দেবী জগদ্ধাত্রী বসেন কাঠের সিংহাসনে।
শান্তিপুরের ব্রহ্মচারী পরিবার- ১৮-১৮৯৫ সাল নাগাদ এই বাড়িতে পুজো শুরু হয়। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, এই বংশের আদিপুরুষ চামু ব্রহ্মচারী বাস করতেন অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের নাটোরে। এই পরিবারের আদি পদবি বাগচী। সৎ-মা এবং নিজের মায়ের দ্বন্দ্বের কারণেই পৈতের সময়ে তিন দিনের রাত্রিবাস শেষ করার আগেই চামু দণ্ডীঘর থেকে বেরিয়ে আসেন সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য। চামুর উত্তরপুরুষ রামগোপাল ব্রহ্মচারী মালঞ্চ থেকে বেরিয়ে শান্তিপুরে চলে যান। রামগোপালের মাতুলালয় ছিল শান্তিপুরের মৈত্র পরিবার। মৈত্র পরিবারের রজনীকান্ত মৈত্রের সঙ্গে ব্রহ্মচারী ব্যাবসার কারণে সংযোগ স্থাপন করেন এবং শান্তিপুরে চলে আসেন। তিনি শান্তিপুরে নিজের বসত বাড়ি এবং আটচালা নির্মাণ করেন। নির্মাণের পরেই দেবীর স্বপ্নাদেশ পান যে কালীপুজোর পরেই আয়োজন করতে হবে জগদ্ধাত্রী পুজোর। সেই শুরু…
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।