Advertisement
২৮ এপ্রিল ২০২৪

এক মাস বন্ধ পেট্রোকেম, ধুঁকছে প্লাস্টিক শিল্পও

হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের দরজা বন্ধে দমবন্ধ দশা রাজ্যের প্লাস্টিক শিল্পেরও। আজ প্রায় এক মাস কারখানা বন্ধ পেট্রোকেমের। তাই সমস্যা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে তার পক্ষে। কিন্তু সেই সঙ্গে আতান্তরে রাজ্যের প্লাস্টিক শিল্পও। পেট্রোকেমের তৈরি কাঁচামাল ব্যবহার করে বালতি থেকে শুরু করে পেনের রিফিল বহু জিনিস তৈরি করে যারা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৪ ০৩:১০
Share: Save:

হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালসের দরজা বন্ধে দমবন্ধ দশা রাজ্যের প্লাস্টিক শিল্পেরও।

আজ প্রায় এক মাস কারখানা বন্ধ পেট্রোকেমের। তাই সমস্যা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে তার পক্ষে। কিন্তু সেই সঙ্গে আতান্তরে রাজ্যের প্লাস্টিক শিল্পও। পেট্রোকেমের তৈরি কাঁচামাল ব্যবহার করে বালতি থেকে শুরু করে পেনের রিফিল বহু জিনিস তৈরি করে যারা।

প্লাস্টিক পণ্য নির্মাতাদের সংগঠন ইন্ডিয়ান প্লাস্টিকস ফেডারেশনের অভিযোগ, পেট্রোকেমের থেকে কাঁচামাল না-পাওয়ায় ইতিমধ্যে শুধু এ রাজ্যেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে অন্তত ২০০ কারখানা। রুজি-রুটি হারিয়েছেন প্রায় দেড় হাজার কর্মী। ব্যবসা তলানিতে ঠেকায় কমছে রাজস্বের অঙ্কও। কারণ, প্লাস্টিক শিল্পের এই বেহাল দশার কারণে প্রতি মাসে ১০০ কোটি টাকা কর হারাচ্ছে রাজ্য সরকার। অর্থাৎ, পেট্রোকেমের কারখানার দরজা বন্ধ থাকায় লোকসানের বহর বাড়ছে বিনিয়োগকারীদের। রাজস্ব হারাচ্ছে রাজ্য। আরও বেশি করে অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে সংস্থার কর্মীদের ভবিষ্যৎ। আবার সেই সঙ্গে তার জেরে আঁধার ঘনাচ্ছে অনুসারী প্লাস্টিক শিল্পের উপর। নিজেদের সমস্যার কথা জানিয়ে শিল্প এবং অর্থ মন্ত্রী অমিত মিত্রকে চিঠিও দিয়েছে প্লাস্টিকস ফেডারেশন।

ছোট ও মাঝারি শিল্পের উপর জোর দেওয়ার কথা প্রায়শই বলে তৃণমূল সরকার। অথচ রাজ্য সরকারের অংশীদারি থাকা পেট্রোকেমের দরজা বন্ধে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সম্ভবত এই শিল্পই। কারণ, সংস্থা হিসেবে পেট্রোকেমের পথ চলা শুরুই হয়েছিল ছোট ও মাঝারি শিল্পের জোগানদার হিসেবে। লক্ষ্য ছিল, পেট্রোকেমে উৎপাদিত পণ্য মূলত ব্যবহৃত হবে ছোট ও মাঝারি প্লাস্টিক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে। যা দিয়ে বালতি থেকে পেনের রিফিল অনেক কিছুই তৈরি করতে পারবে তারা।

পেট্রোকেমের কারখানায় ন্যাপথা চূর্ণের সঙ্গে কিছু রাসায়নিক মিশিয়ে তৈরি হয় ‘প্লাস্টিক গ্র্যানিউলস’ বা প্লাস্টিকের দানা। পলিপ্রপিলিন, এইচডিপিই, পিই এবং এলডি নামে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের দানা তৈরি হয় এখানে। এর মধ্যে আবার এইচডিপিই উৎপাদনের ক্ষেত্রে পেট্রোকেম প্রথম সারির সংস্থা। বোতল, খেলনা, বালতি, ক্যারি ব্যাগের মতো বিভিন্ন জিনিস তৈরির জন্য এইচডিপিই ব্যবহার হয়। ফলে এখন সেই কাঁচামালে ঘাটতি টের পাওয়া যাচ্ছে ওই সমস্ত নিত্য ব্যবহার্য পণ্য তৈরি করতে গিয়ে। অথচ শুধু এ রাজ্যেই এ ধরনের জিনিসের বাজার অন্তত ৫০০ কোটি টাকার। পূর্বাঞ্চলে ৮০০ কোটি। কাঁচামালের অভাবে এই বাজার ক্রমশ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে বলে প্লাস্টিক শিল্পমহলের আশঙ্কা।

তা ছাড়া, মূলত পেট্রোকেমে তৈরি পণ্যের ভরসায় গড়ে ওঠা অনুসারী শিল্প আড়ে-বহরে নেহাত কম নয়। পশ্চিমবঙ্গ-সহ পূর্বাঞ্চলে ৫,০০০ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগে তৈরি হয়েছে প্লাস্টিক শিল্প। রয়েছে ২,৫০০ কারখানা। যার সিংহভাগই এ রাজ্যে। এই সমস্ত কারখানায় কাজ করেন ৫০ হাজারেরও বেশি কর্মী। ইন্ডিয়ান প্লাস্টিকস ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট প্রদীপ নায়ারের দাবি, “পেট্রোকেমের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ প্রশ্ন তুলে দিয়েছে এই ৫০ হাজার শ্রমিকের রুজি-রুটি নিয়েও। ওই সব কারখানা চালানোর মতো কাঁচামাল নেই। ফলে পেট্রোকেম দ্রুত না-খুললে, একে একে সব বন্ধ হয়ে যাবে।”

রাজ্যে জমি-জট সমেত বিভিন্ন কারণে বড় শিল্পে লগ্নির খরা অব্যাহত। এবং সেই পরিসংখ্যান স্পষ্ট বণিকসভা সিআইআই, আইসিসি, ফিকি প্রায় সব রিপোর্টেই। নতুন বড় শিল্প তো দূর অস্ৎ, বরং একে একে বন্ধ হয়ে দিয়েছে হিন্দ মোটর, ডানলপ, নোকিয়া-সিমেন্স, শালিমার পেন্টসের মতো বেশ কিছু কারখানা। তথ্যপ্রযুক্তিতেও দীর্ঘ দিন ঝুলে রয়েছে ইনফোসিসের মতো নামী সংস্থার বিনিয়োগ। এই পরিস্থিতিতে সেই খামতি কিছুটা ঢাকতে রাজ্য যখন ছোট ও মাঝারি শিল্প গড়ায় জোর দেওয়ার কথা বলছে, তখন প্লাস্টিক শিল্পের এই দশা ফের নতুন করে সংশয় বাড়াচ্ছে শিল্পমহলের অন্দরে। এক শিল্প কর্তা বলছেন, “পাটের মতো পুরনো প্রযুক্তির (সানসেট) শিল্প চলে যাওয়ার পর প্রায় ভেঙে পড়েছিল রাজ্যের অর্থনীতি। তা সিধে করতে প্রয়োজন প্লাস্টিক, তথ্যপ্রযুক্তির মতো নতুন যুগের (সানরাইজ) শিল্প। এখন তারও অভাব ঘটলে, রাজ্যে কী শিল্প হবে?”

উল্লেখ্য, গত বুধবার পেট্রোকেমের পরিচালন পর্ষদের বৈঠক হয় রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমের দফতরে। আলোচনা শেষে সংস্থার অন্যতম প্রধান অংশীদার চ্যাটার্জি গোষ্ঠীর কর্ণধার পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের দাবি ছিল, পরিচালন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন কারখানার অবস্থা যথেষ্ট ভাল।

কিন্তু তা হলে পেট্রোকেম খুলতে বাধা কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, ঋণদাতা সংস্থাগুলির টাকা মেটাতে হবে। যদিও গত ৬ জুলাই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণ দেখিয়ে কারখানা বন্ধ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ত্রুটি ধরা পড়েছে ন্যাপথা ক্র্যাকারে।

সংস্থা সূত্রেও খবর, এমনিতে প্রতি ঘণ্টায় ২৬০ টন ন্যাপথা চূর্ণ করার ক্ষমতা রাখে পেট্রোকেমের ক্র্যাকার। কিন্তু বন্ধের আগে সেখানে ন্যাপথা ব্যবহৃত হচ্ছিল বড়জোর ১১০-১২০ টন। ১১০ হোক বা ১৮০ টন ক্র্যাকারে তা চূর্ণ করার অন্যান্য খরচ প্রায় একই। বাড়তি বলতে শুধু ওই ৭০ টন বাড়তি ন্যাপথার দাম। ফলে তা জুগিয়ে ক্র্যাকারকে ঘণ্টা-পিছু অন্তত ১৮০ টন ন্যাপথা জোগাতে পারলে, তবে উৎপাদন খরচে পড়তা পরে। সম্ভব হয় নগদ লাভের মুখ দেখা। কিন্তু প্রশ্ন হল, বন্ধের আগে যেখানে ঘণ্টায় ১১০-১২০ টন ন্যাপথা জোগাতেই পেট্রোকেম হিমসিম খাচ্ছিল, সেখানে ১৮০ টনের খরচ তারা জোগাবে কোথা থেকে? ওই বাড়তি কাঁচামাল কিনতে যে টাকা (কার্যকরী মূলধন) প্রয়োজন, তা পেট্রোকেমের নেই। আবার মালিকানা-সমস্যা না-মেটা পর্যন্ত ওই টাকা নতুন করে আর ধার দিতেও রাজি নয় ঋণদাতা সংস্থাগুলি।

অথচ রাজ্যের প্লাস্টিক শিল্পের দাবি, নিজেদের উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৫০ শতাংশ ব্যবহার করা সত্ত্বেও পূর্বাঞ্চলে প্রায় ৪০ শতাংশ বাজার রয়েছে পেট্রোকেমের। বন্ধের আগে পেট্রোকেম থেকেই ৮০ শতাংশ কাঁচামাল পেতেন তাঁরা। ফি মাসে ১৭ হাজার টন কাঁচামাল সরবরাহ করত পেট্রোকেম। এখন সেই জোগান পুরো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা চূড়ান্ত দুর্ভোগে পড়েছেন বলে প্রদীপবাবুর অভিযোগ। তাঁর মতে, রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজ, ইন্ডিয়ান অয়েল বা গেইলের মতো সংস্থার কাছ থেকেও পর্যাপ্ত কাঁচামাল পাওয়া শক্ত। কারণ, পশ্চিম ও উত্তর ভারতে তা জোগান দেওয়া

পেট্রোকেমের দরজা বন্ধের দরুন কাঁচামালের অভাবে রাজ্যে গুটিয়ে যাচ্ছে একের পর এক প্লাস্টিক কারখানা। পেট্রোকেমের ওয়েবসাইটে যদিও জ্বলজ্বল করছে তার আদর্শ ‘কাম, গ্রো উইথ আস’। বাস্তব অবশ্য অন্য কথা বলছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

haldia petrochem plastic industry
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE