ইউক্রেনে রাশিয়া সরাসরি আগ্রাসনের পথেই চলিয়াছে। এত কাল রুশভাষী ও রাশিয়া-সমর্থক বিদ্রোহীদের দিয়া রাশিয়া প্রক্সি-যুদ্ধ চালাইতেছিল। বিদ্রোহীদের অস্ত্রশস্ত্র, বন্দুক-কামান-ক্ষেপণাস্ত্র, পর্যাপ্ত রসদ ও অর্থ জোগাইতেছিল, যাহার সাহায্যে তাহারা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করিতেছিল। এ বার সরাসরি রুশ ট্যাংক ও সাঁজোয়া গাড়ি সারিবদ্ধ ভাবে সীমান্ত অতিক্রম করিয়া বিদ্রোহীদের ডেরার অভিমুখে গিয়াছে। ইউক্রেন এই বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে আঁটিয়া উঠিবে না বুঝিয়া মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘ন্যাটো’-র সদস্যপদের জন্য আবেদন জানাইয়াছে। কিছু কাল আগে কেবল ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক জোটের সদস্য হইতে চাওয়াতেই ক্রুদ্ধ রাশিয়া ইউক্রেনে ব্যাপক অন্তর্ঘাত চালায়। প্রতিবাদে ইউক্রেনবাসী রুশ-তাঁবেদার শাসক গোষ্ঠীকে দেশ হইতে নির্বাসিত করার পরেই শুরু হয় তথাকথিত বিদ্রোহীদের উস্কাইয়া ক্রাইমিয়াকে ইউক্রেন হইতে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা। তাহাতে সফল হওয়ার পর অন্যান্য জনপদে বসবাসকারী রুশদের সশস্ত্র বিদ্রোহে শামিল করিয়া এবং অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদে সুসজ্জিত করিয়া কার্যত ইউক্রেনকে খণ্ড-খণ্ড করার অভিযান চলিয়াছে। এই অবস্থায় ইউক্রেনের কাছে ন্যাটোর সাহায্যপ্রার্থনা ছাড়া উপায় কী?
একদা সোভিয়েত সাম্রাজ্যের অধীন এই প্রজাতন্ত্রের পছন্দের স্বাধীনতা খর্ব করিয়া তাহাকে মস্কোর তাঁবে রাখিতেই প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের যাবতীয় তৎপরতা। তিনি আবার ইউক্রেনের এই স্বাধিকারপ্রমত্ততাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের নাত্সি আগ্রাসনের সহিত তুলনা করিয়াছেন। কী চমকপ্রদ ইতিহাসবোধ! বস্তুত আগ্রাসনকারী তো রাশিয়া, ইউক্রেন আক্রান্ত দেশ। রুশ সাম্রাজ্যবাদ ইউক্রেনের গত হাজার বছরের স্বাধীন জাতীয় অস্তিত্ব অস্বীকার করে। ইউক্রেনের তরফে ন্যাটোর সদস্য হওয়ার আবেদনে পুতিনের আধিপত্যকামিতাকে চিনাইয়া দিবার প্রয়াস আছে। ন্যাটো, ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা ঘুচাইয়া একটি আক্রান্ত ও বিপন্ন ইউরোপীয় জাতিসত্তার পাশে দাঁড়াইবার আর্জিও। রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রসাধনী কিছু অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারির বাহিরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনও কোনও ব্যবস্থা লয় নাই। ইউক্রেন তাই সরাসরি ন্যাটোর সদস্য হইয়া ইউরোপ ও আমেরিকার কাছে সামরিক রক্ষাকবচ চাহিতেছে। তবে এই ধরনের রক্ষাকবচে ইউক্রেনকে মুড়িয়া ফেলিতে ন্যাটো বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত কি না, সন্দেহ।
ইউক্রেনের সেনাবাহিনী যে রাশিয়ার মহড়া লইতে অপারগ, তাহা স্পষ্ট। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যেখানে সিরিয়ায় ইসলামি রাষ্ট্রবাদীদের নির্মূল করার অভিযানে নামিতেই দ্বিধান্বিত, সেখানে ঠাণ্ডা যুদ্ধের প্রত্যাবর্তনের শঙ্কায় জুজু হইয়া থাকা মার্কিন-ইউরোপীয় শাসকদের কাছ হইতে সাহায্য মেলার সম্ভাবনা দূরপরাহত। অগত্যা ইউক্রেনীয়দের নিজেদের জীবন ও সম্পত্তির সুরক্ষার তোড়জোড়। ইউক্রেনবাসী অতএব চরম হতাশার মধ্যেই রুশ আগ্রাসনের জন্য নিজেদের মতো করিয়া প্রস্তুতি লইতেছে। প্রস্তুতি মূলত রক্ষণাত্মক। আক্রান্ত হইলে যথাসম্ভব আত্মরক্ষা করার আয়োজন। জারের যে-সাম্রাজ্য লেনিন-স্তালিনরা উত্তরাধিকারসূত্রে পান, মিখাইল গোর্বাচভের পেরেস্ত্রইকার ঠেলায় যাহা অংশত হাতছাড়া, তাহার পুনরুদ্ধারই প্রাক্তন কেজিবি-প্রধানের ব্রত। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বর্তমান অবস্থায়, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতার প্রেক্ষিতে এই ব্রত সফল হইবার সম্ভাবনা অনুজ্জ্বল বলা চলে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy