ভাদ্র আসিলে বৈশাখ কি আর দূরে থাকিতে পারে? সাড়ে ছয় মাস পরে হইলেও পয়লা বৈশাখ আসিবেই। এবং, সেই শুভ ক্ষণে বাসভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য গঠিত ‘টাস্ক ফোর্স’ কাজ শুরু করিবে। পয়লা বৈশাখই কেন, এমন প্রশ্ন কেহ করিবেন বলিয়া বোধ হয় না। শুভ কাজের জন্য শুভ ক্ষণ বিলক্ষণ প্রয়োজন। প্রতি বৎসর ওই দিনেই বহু দোকানে নূতন হালখাতা চালু হয়। তবে, প্রতীক্ষাটি কিঞ্চিৎ দীর্ঘ হইতেছে। সামনেই মহালয়া, তাহার পর ঈদ, দীপাবলি, বড়দিন, পৌষ সংক্রান্তিও আসিতেছে। কিন্তু নববর্ষের মহিমা অতুল। অতএব ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির সহিত সঙ্গতি রাখিয়া বাসভাড়া বাড়িবে, এমন বিরল সিদ্ধান্ত রূপায়ণের পথে এক পা ফেলিবার জন্য সাড়ে ছয় মাস অপেক্ষা ভিন্ন আর উপায় কী?
তবে, এই দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর্বতটি শেষ পর্যন্ত কী প্রসব করিবে, ‘পরিবহণমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে’ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাহা ফাঁস করিয়া ফেলিয়াছেন। বলিয়াছেন, টাস্ক ফোর্স যাহাই বলুক না কেন, ভাড়া বাড়াইবার— সুতরাং না-বাড়াইবার— অধিকার থাকিবে মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই। যথা পূর্বং তথা পরম্। এত দিন পরিবহণমন্ত্রীর মতামত গ্রাহ্য হইত না। আশঙ্কা, অতঃপর টাস্ক ফোর্সের মতামত গ্রাহ্য হইবে না। কিন্তু তাহার পূর্বে প্রশ্ন, হঠাৎ টাস্ক ফোর্স কেন? কোনও একটি বিশেষ কাজ এক বার উদ্ধার করিয়া দেওয়ার জন্য টাস্ক ফোর্স গঠিত হয়। ডিজেলের দামের সহিত বাসভাড়ার সঙ্গতিরক্ষার কাজটি সেই গোত্রের নহে। এ ক্ষেত্রে যাহা প্রয়োজন, তাহার নাম নিয়ন্ত্রক সংস্থা, টাস্ক ফোর্স নহে। তর্কের খাতিরে ধরিয়া লওয়া যাউক, মন্ত্রিবর মুখে যাহাই বলুন না কেন, আসলে তিনি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কথাই বলিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা কী ভাবে গঠিত হয়, তাহা কী ভাবে কাজ করে, সে বিষয়ে রাজ্যের শাসকদের স্পষ্ট ধারণা আছে কি? মন্ত্রিমহোদয় জানাইয়াছেন, তাঁহাদের প্রস্তাবিত সংস্থায় বাসমালিক এবং সরকার, উভয় পক্ষের প্রতিনিধিই থাকিবেন। কোনও নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থায় কোনও স্বার্থগোষ্ঠীর প্রতিনিধি না থাকা বিধেয়। বাসভাড়া সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থায়, অতএব, বাসমালিক এবং সরকার, কোনও পক্ষের উপস্থিতিই কাম্য নহে। সংস্থা প্রয়োজনবোধে সকল স্বার্থগোষ্ঠীর সহিতই আলোচনা করিবে, কিন্তু সিদ্ধান্ত তাহার নিজস্ব। নিয়ন্ত্রক সংস্থায় স্বার্থগোষ্ঠীর উপস্থিতি সংস্থার নিরপেক্ষতা নষ্ট করে, ফলে তাহা চরিত্রভ্রষ্ট হয়। পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা এই প্রাথমিক ব্যাকরণও জানেন না, অথবা মানেন না।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা গড়িলে তাহার মতামতের গুরুত্বও স্বীকার করিতে হয়। বলা চলে না, সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার থাকিবে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে। পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন এই পথেই চলে। শিক্ষা হইতে পরিবহণ, শিল্প হইতে পর্যটন, সব ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী এক জন। তিনি বঙ্গেশ্বরী, তাঁহার ক্ষমতা অসীম। তাঁহার পারিষদরা এই ব্যবস্থায় অতি সন্তুষ্ট নেত্রীকে চটাইয়া নিজের আসন খোয়াইবার হঠকারিতা করিতে কেহ আগ্রহী নহেন। এই ব্যবস্থাই যখন চলিবে, তখন নাটকের প্রয়োজন কী? ডিজেলের দাম বাড়িলে বাড়িবে, বাসমালিকরা ক্ষতি সহিতে না পারিয়া বাস চালানো বন্ধ করিলে করিবেন। ভোট আগে, না অর্থনীতির সামান্য যুক্তি? পশ্চিমবঙ্গ যেমন চলিতেছে, তেমনই চলিবে। আরও কয়েক জন অনুগতকে সরকারি সুবিধার ব্যবস্থা করিয়া দেওয়ার জন্য একটি নূতন টাস্ক ফোর্সের প্রয়োজন নাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy