Advertisement
২৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

কেবল মৃতদেহে হাত দিয়ে বসে থাকা

সময়কে সৃষ্টিসুখের চিয়ার্স না করে বাংলা লিট্ল ম্যাগ এখন লঙ্গরখানায় সময়ের সেবাদাস। বইমেলায় টেবিলে বসার লোক খুঁজে পায় না সে! নিজের মৃতদেহ নিজেই বয়ে চলেছে, শোভাযাত্রাসহ। দেবতোষ দাশ লিট্ল, তা সে যতই লিট্ল হোক, বড় তারে বলে গাঁয়ের লোক। তার নাকি লিট্লতাতেই আনন্দ। আরে, ‘লিট্ল বয়’ তো আর সত্যি সত্যি পুঁচকে ছোঁড়া নয়, পারমাণবিক বোমা। লিট্ল ম্যাগাজিনও, বৃহৎ বপুদের মাটি ধরিয়ে ফটাফট মাথার ওপর তুলে ফেলছে পেল্লাই ওজন। তাই বলে শুধু বিষয়-বৈচিত্রে ওজনদার হলেই পত্রিকা লিট্ল ম্যাগাজিন হয় না, জাফরান ছাড়া যেমন বিরিয়ানি বরবাদ, প্রতিবাদ ছাড়া লিট্ল ম্যাগাজিনও তাই।

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৩১
Share: Save:

লিট্ল, তা সে যতই লিট্ল হোক, বড় তারে বলে গাঁয়ের লোক। তার নাকি লিট্লতাতেই আনন্দ। আরে, ‘লিট্ল বয়’ তো আর সত্যি সত্যি পুঁচকে ছোঁড়া নয়, পারমাণবিক বোমা। লিট্ল ম্যাগাজিনও, বৃহৎ বপুদের মাটি ধরিয়ে ফটাফট মাথার ওপর তুলে ফেলছে পেল্লাই ওজন। তাই বলে শুধু বিষয়-বৈচিত্রে ওজনদার হলেই পত্রিকা লিট্ল ম্যাগাজিন হয় না, জাফরান ছাড়া যেমন বিরিয়ানি বরবাদ, প্রতিবাদ ছাড়া লিট্ল ম্যাগাজিনও তাই। সাহিত্যকে টিভি সিরিয়ালতুল্য তরল বানিয়ে যারা বহু পাঠককে হাত করতে চায়, নাফা তুলতে চায় বটুয়ায়, তাদের প্রতি তীব্র ঘৃণাথুতু বিসর্জন করে এ-রাগ ও-প্রতিবাদের সূত্রপাত। সে ম্যানিফেস্টোর গর্জন: লিট্ল ম্যাগ কেবল পাঠকের মনোরঞ্জন করবে না, তাকে সচেতন করবে। স্বাধীন অভিব্যক্তি ও প্রকৃত সত্য তুলে আনবে। প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতা দেওয়ার একটা ভান করে বটে, কিন্তু কখনওই দেয় না। আত্মসমর্পণকারী লেখককে সে মাথায় তুলে নাচে। পরে ছিবড়ে করে ছুড়ে দেয় বায়ুমণ্ডলে।এই বজ্রঘোষণা নিয়ে, প্রতিষ্ঠানেরই প্রতিস্পর্ধী অবতার রূপে, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে, লিট্ল ম্যাগের আবির্ভাব। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বা পি এফ ভেঙে তৈরি হয় সে ভিয়েন। কখনও নাকি রক্ত বেচেও!

এ পর্যন্ত পড়ে বাঙালি পাঠক হাই তুলবে। পঞ্চাশ-টপকানো পাঠক ভাববে, সে ছিল এক দিন আমাদের যৌবনে কলকাতা! বিলো ফিফ্টি ভাববে, ট্রাঙ্ক ঘেঁটে, নস্টালজিয়া চেটে, এ সব কী ন্যাপথলিন হচ্ছে! আর জেনারেশন ওয়াই না জেড, তারা এ সব ডেটেড আলোচনা ‘ফালতু ফুটেজ খাচ্ছে’ বলে ফেসবুকে নতুন কবিতা পোস্ট করবে। এমনটা ভাবলে, ঠিকই ভাবা হবে। এ কাহন ন্যাপথলিনের। এ এক এমন দিনের কথা, যখন প্রতিবাদ টিভি ক্যামেরা-নির্ভর হয়ে যায়নি। সাঁটা হয়নি লেপেল বুদ্ধিজীবীদের কলারে, ব্লাউজে। চল্লিশ হয়নি চাল। মল এসে কেড়ে নেয়নি আমাদের লাইটহাউস। ভাসিয়ে দেয়নি দিগ্ভ্রান্ত দরিয়ায়। আর সবার ওপরে ছিল বাম। ইহা বিজ্ঞান, ইহা সত্য, ইহা সর্বশক্তিমান আউড়ে সে রাজনীতি শোয়ারজেনেগারের মতো মাস্ল দেখাত। বাম থেকে বামন হয়ে যায়নি তখনও।

কিন্তু সে বিপুল তরঙ্গ আজ তোরঙ্গায়িত। এ দিকে কম্পিউটার ক্রমশ ছোট হচ্ছে, মোবাইল ক্রমাগত বড়। আর ও দিকে, মিছিলের মশাল, মোমবাতি নামক মিনিয়েচার মশালে নেমে এসেছে। এর পর হয়তো দেশলাই কাঠির মশাল। নাটা জোকারদের মিছিল। যাদের অনেকটা পড়াশোনা আছে, তারা বলে, এ জিনিস নাকি বামেরা গভর্নমেন্ট বানাবার পর থেকেই শুরু হয়েছিল। সব কিছুরই বনসাই হওয়ার পালা। যাহা বচ্চন, তাহাই জুনিয়র মেহমুদ। না মানলে এলসি-র সপাং!

বামেদের গাঁ-ছাড়া করার সময় গাছাড়া লিট্লদের তেমনটি পাওয়া যায়নি, যতটা পাওয়া গিয়েছিল থিয়েটারের মানুষদের। থিয়েটারের লোকেরা পেরেছিল, লিট্ল বৃদ্ধ পারেনি। তার সব দাঁত পড়ে গিয়েছে। লিট্ল ম্যাগাজিন আছে, কিন্তু তার ম্যাগাজিন থেকে কেউ খুলে নিয়েছে টোটা। জামাকাপড় খুলে নেওয়ার মতো ব্যাপার। তাও তার সাড় নেই। নিধিরাম দাঁড়িয়ে পাহারা দেয় তার সাধের মনুমেন্ট। আসলে অভ্যাস। আর অভ্যাসের দাস বাঁচে না, টিকে যায়। প্রাচীন অরণ্য প্রবাদ।

আকারে ছোট, প্রচারে ছোট, আয়ুতেও ছোট তাই সে ছিল লিট্ল। এই ‘ক্ষুদ্রতা’ তার জানা, এ নিয়ে অহংকারও ষোলো আনা। এখন আকারের ক্ষুদ্রতা সে কাটিয়ে ফেলেছে। সে তিন ফর্মা হলে লিট্ল, ঠিক আছে, তাই বলে হাজার পাতার অভিধান মার্কা হলেও লিট্ল! বিজ্ঞাপনে ছয়লাপ আর বইমেলায় টেবিল থেকে সটান স্টলে লাফ দিলেও লিট্ল! প্রচারের কথা না তোলাই ভাল। শেষ বেলায় স্টক ক্লিয়ার করতে আধা দামে সেল দেয় বন্ধুদের। আর আয়ু কম? এ-ও তো তার একদা শ্লাঘার স্থান! সারা জীবন কেরানির চাকরি কেন টানবে স্পর্ধিত রাজপুত্র? কিন্তু হায়, দেখা গেল, প্রতিস্পর্ধী বিকল্প ভাবনা ভুলে ভালগার চিন্তার ডাস্টবিনকে বয়ে নিয়ে যেতে হয় যেহেতু শিকড় চারিয়ে গেছে বহু দূর। গোষ্ঠী হয়েছে, প্রকাশনা হয়েছে, ডলারের গ্রাহক হয়েছে। তাই সংখ্যার পর সংখ্যা, সংখ্যার পর সংখ্যা, সংখ্যার পর সংখ্যা তারিখ পর তারিখ, তারিখ পর তারিখ, তারিখ পর তারিখ হা ঈশ্বর, আমাদের কোনও সানি দেওল-ও ছিল না যে মুখের ওপর প্রশ্ন তুলতে পারে।

মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয় এমন লেখার অভাব, তাই আমাদের পত্রিকাটি আর বেরোবে না এমন কলার তোলা ঘোষণা ছুড়ে বিদায় নিয়েছিল তীব্র-তীক্ষ্ণ লিটল ম্যাগ, এমন নজিরও আছে এ শহরে! হরফের পর হরফ সাজিয়ে নিরক্ষর হাঁদা-হাততালি চায়নি সে। গালি ভেঙে চলে গিয়েছিল। অনাবিল পাঠক তার রিসাইক্ল বিন ঘেঁটে সেঁকে নেয় নিজেকে। ছুঁয়ে নেয় টোটা। কী আশ্চর্য, গরম! এখনও।

কিন্তু তোমার না-বেঁচে সাহিত্যের পাড়ায় পাড়ায় থান হয়ে, প্রণামীর বাক্স খুলে, স্রেফ টিকে থাকা, এমন কথা তো সে দিন ছিল না মান্যবর। তোমার হয়ে কলম ধরেছিলেন স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু। ১৯৫৩ সালে মে মাসে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ‘লিটল ম্যাগ কী’ গোছের ম্যানিফেস্টোবৎ সাবেকি সংজ্ঞাটিতে বুলিয়ে নিই দু’নয়ন: ‘একরকমের পত্রিকা আছে যা আমরা রেলগাড়িতে সময় কাটাবার জন্য কিনি, আর গন্তব্য স্টেশনে নামার সময় ইচ্ছে করে গাড়িতে ফেলে যাই... আর এক রকমের পত্রিকা আছে যা আমরা চোখ বুলিয়ে সরিয়ে রাখি না, চেয়ে চেয়ে আস্তে আস্তে পড়ি, আর পড়া হয়ে গেলে গরম কাপড়ের ভাঁজের মধ্যে ন্যাপথলিন-গন্ধী তোরঙ্গে তুলে রাখি জল, পোকা আর অপহারকের আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য। যে সব পত্রিকা এই দ্বিতীয় শ্রেণির অন্তর্গত হতে চায়, কৃতিত্ব যেটুকুই হোক, অন্ততপক্ষে নজরটা যাদের উঁচুর দিকে, তাদের জন্য নতুন একটা নাম বেরিয়েছে মার্কিন দেশে, চলতি কালের ইংরেজি বুলিতে এদের বলা হয়ে থাকে লিটল ম্যাগাজিন। ...আমরা যাকে বলি সাহিত্যপত্র, খাঁটি সাহিত্যের পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন তারই আরও ছিপছিপে এবং ব্যঞ্জনাবহ নতুন নাম। ...সময়ের সেবা না করে সময়কে সৃষ্টি করার চেষ্টা এইটেই লিটল ম্যাগাজিনের কুলধর্ম।’

বুদ্ধদেব এই ইস্তেহার লিখে ন্যুব্জ বাংলা লেখালেখিকে হেলমেটহীন শির, চুইংগামীয় চোয়ালসহ ভিভ রিচার্ডসীয় ঔদ্ধত্য দিতে চেয়েছিলেন। ৪০ বছর হল তাঁর মৃত্যু হয়েছে, তিনি কী করে জানবেন, সময়কে সৃষ্টিসুখের চিয়ার্স না করে বাংলা লিট্ল ম্যাগ এখন লঙ্গরখানায় সময়ের সেবাদাস। বইমেলায় টেবিলে বসার লোক খুঁজে পায় না সে! নিজের মৃতদেহ নিজেই বয়ে চলেছে, শোভাযাত্রাসহ।

নতুন মিলেনিয়ামের জেন-নেক্সট এ সবের ধার ধারেনি। গোষ্ঠী, গোষ্ঠীপতি, তালেবরিকে কলা দেখিয়ে চলে গিয়েছে চলমান অশরীরীর কাছে, ভার্চুয়াল স্পেসে খুঁজে নিয়েছে আগুন। ফেসবুকের ওয়ালে থাবড়ে দিচ্ছে কবিতা, ব্লগের সাদায় ঠেসে দিচ্ছে গদ্যের তন্দুর। পারলে পড়ে নাও।

মৃতদেহ একা রাখতে নেই। স্পর্শ করে থাকতে হয়। কেবল এই বিশ্বাসে মৃতদেহে হাত দিয়ে বসে থাকা। এখন এই হাতটুকুই যা ডেডবডি থেকে সরিয়ে নেওয়ার অপেক্ষা। বাকিটা কর্পোরেশন বুঝে নেবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

debatosh das little magazine
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE