Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

চিকিৎসা বিপর্যয়

অবহেলাও অপরাধ। এ রাজ্যের হাসপাতাল তাহা বার বার প্রমাণ করিতেছে। রক্ত সংগ্রহের পর এক শিশুর হাতের বাঁধন খুলিতে ভুলিয়া গেলেন আসানসোলের সরকারি হাসপাতালের নার্স। দুই দিন পরে পচনগ্রস্ত হাতটি বাদ দিতে হইল। ইহা অবিশ্বাস্য। অথচ আর অপ্রত্যাশিত নহে। গত জুলাই মাসে স্যালাইনের নল কাটিতে গিয়া বালুরঘাটে শিশুর আঙুলই বাদ দিয়াছিলেন এক নার্স। অক্টোবরে মেডিক্যাল কলেজে দুই নবজাতক পুড়িয়া মারা গেল। তাহাদের ওয়ার্মার যন্ত্রটি বন্ধ করিতে ভুল হইয়া গিয়াছিল কর্তব্যরতদের।

শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:৫৯
Share: Save:

অবহেলাও অপরাধ। এ রাজ্যের হাসপাতাল তাহা বার বার প্রমাণ করিতেছে। রক্ত সংগ্রহের পর এক শিশুর হাতের বাঁধন খুলিতে ভুলিয়া গেলেন আসানসোলের সরকারি হাসপাতালের নার্স। দুই দিন পরে পচনগ্রস্ত হাতটি বাদ দিতে হইল। ইহা অবিশ্বাস্য। অথচ আর অপ্রত্যাশিত নহে। গত জুলাই মাসে স্যালাইনের নল কাটিতে গিয়া বালুরঘাটে শিশুর আঙুলই বাদ দিয়াছিলেন এক নার্স। অক্টোবরে মেডিক্যাল কলেজে দুই নবজাতক পুড়িয়া মারা গেল। তাহাদের ওয়ার্মার যন্ত্রটি বন্ধ করিতে ভুল হইয়া গিয়াছিল কর্তব্যরতদের। এ বার হাত বাদ গেল আসানসোলের আড়াই বৎসরের শিশুর। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যাইতেছে, ডাক্তার ও নার্সদের অল্প অসতর্কতা, সামান্য ভ্রান্তি হইতে বিপুল, অপূরণীয় ক্ষতি হইতেছে রোগীর। কিন্তু এমন ভ্রান্তি কি ব্যতিক্রম? এমন ঘটনা যে বারবার ঘটিতেছে, তাহা ইঙ্গিত করে যে এই মারাত্মক উদাসীনতা চিকিৎসাব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়া গিয়াছে। ইহা আর ব্যতিক্রম নহে, ইহাই নিয়ম। বালুরঘাট হাসপাতাল বা কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ, কোনও ক্ষেত্রেই ডাক্তার, নার্সরা দোষ স্বীকার করেন নাই। বরং প্রতিবাদ করিয়া বলিয়াছেন, তাঁহাদের উপর কাজের চাপ অত্যধিক, তাই এমন অসতর্কতা ঘটিতেই পারে, তাহার জন্য শাস্তি দেওয়া অন্যায়। অর্থাৎ, এমন ঘটনা ঘটিতেই পারে!

এ বিষয়ে সন্দেহ নাই যে, সংবাদমাধ্যমে খবরগুলি প্রকাশ না হইলে এই ধরনের অবহেলার তদন্ত, বিচার, শাস্তি প্রভৃতির প্রক্রিয়া কার্যত ধামাচাপা পড়িয়া যাইত। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হইলে সে প্রক্রিয়া কিছুটা গড়ায়। না হলে অভিযোগ জমা পড়িয়াই থাকে। অবহেলার ফলে রোগীর অপচিকিৎসা, এমনকী মৃত্যুর ঘটনা বাস্তবিক কত ঘটিতেছে, সাত মাসে চারটি মর্মান্তিক শিশুমৃত্যুর ঘটনা তাহার একটি ইঙ্গিত মাত্র। প্রশাসন যেখানে কর্মীদের দায়বদ্ধতা লইয়া নীরব, সেখানে অবহেলা ঘটিবেই। ইহা কেবল কর্মীর সংখ্যার প্রশ্ন নহে, কর্মসংস্কৃতির প্রশ্ন। রোগীর চাপ বেশি থাকিলে উচ্চ মানের পরিষেবা না মিলিতে পারে। যাহা রোগীর ন্যূনতম প্রাপ্য, সেটুকু রোগী পাইবেন না কেন? কাজের চাপ সম্পর্কে অবহিত হইয়াই ডাক্তার-নার্সরা দায়িত্ব লইয়াছেন। কাজে ত্রুটি হইলে দায় এড়াইতে তাঁহারা পারেন না। ওই শিশুদের যে বিপর্যয় ঘটিল, তাহা পরিকাঠামোর অভাবের জন্য, না কি কর্মীদের দক্ষতা, মনোযোগ, দায়িত্ববোধের অভাবের জন্য, সে প্রশ্ন সমাজ করিবেই।

প্রশ্ন সরকারের প্রতিও। সরকারি হাসপাতালগুলির পরিকাঠামো যখন এতই দুর্বল, তখন নূতন হাসপাতাল চালু করিতে সরকারের এত আগ্রহ কেন? সম্প্রতি রাজ্য জুড়িয়া ‘মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতাল’ উদ্বোধন করিতেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাহার জন্য ডাক্তার, নার্স জোগাইতে টান পড়িতেছে পুরাতন হাসপাতালের ভাঁড়ারে। তৎসহ হাসপাতাল প্রশাসনের উপর রাজনৈতিক খবরদারি বাড়িয়াছে বই কমে নাই। নেতা-মন্ত্রীদের অনুগ্রহ-প্রাপ্ত এক শ্রেণির ডাক্তার অধ্যক্ষ ও সুপারদের উপর অনবরত ছড়ি ঘুরাইতেছেন। প্রশাসকরা সাহস, উদ্যম হারাইয়াছেন। ফলে যে কাজগুলি হাসপাতালের মৌলিক কাজ, দৈনন্দিন কর্তব্য, সেগুলি অবহেলিত হইতেছে। যে কোনও প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের বিচার করিতে হইলে তাহার মূল লক্ষ্যের নিরিখেই করিতে হইবে, নূতন চমকের হিসাব করা নিরর্থক। হাসপাতালে অনুশাসন, শৃঙ্খলা ফিরিয়া আসুক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE