চিনা কমিউনিস্ট পার্টির নয়া নেতৃত্ব দুর্নীতির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অভিযান চালাইতেছে। সর্বশেষ দৃষ্টান্ত দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক সংস্থা পলিটব্যুরোর স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌ ইয়োং-খাঙের বিরুদ্ধে শুরু করা তদন্ত। চৌ ইয়োং-খাংকে ‘চিনের ডিক চেনি’ বলা হয়। শত-শত কোটি ডলার সম্পত্তির মালিক তিনি ও তাঁহার পরিবার দেশের তৈল সম্পদের উপর একচেটিয়া দখল কায়েম করিয়াছেন। পার্টির ভিতরে তাঁহার অবস্থান যে রূপ, তাহাতে তাঁহাকে রীতিমত রাঘব বোয়ালই বলা চলে। ইতিপূর্বে পার্টি প্রধান শি চিনফিং দুর্নীতির দায়ে যে-সকল পার্টি-কর্মকর্তা ও আমলাকে বিচারের কাঠগড়ায় টানিয়া আনিয়াছেন, তাঁহারা তুলনায় চুনোপুঁটি। একই সঙ্গে কিছু ‘মাছি মারা’র পাশাপাশি কয়েকটি ‘শার্দূলকেও শিকার’ করিতে শীর্ষ নেতৃত্ব বদ্ধপরিকর। তাই সামরিক কমিশনের সহ-সভাপতি, জাতীয় পেট্রোলিয়াম নিগমের প্রধান, জাতীয় নিরাপত্তার বেজিং ব্যুরোর আধিকারিক কিংবা সরকারি টেলিভিশনের জনপ্রিয় তারকার পর আরও প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য পার্টি নেতাকে বিচারাধীন করা হইল। প্রক্রিয়াটির সূচনা অবশ্য দুর্নীতির দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত প্রাক্তন পলিটব্যুরো সদস্য পো শিলাইয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত মারফত।
দলপতি ও রাষ্ট্রনায়ক শি চিনফিং যে দল ও দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করিতে ব্যগ্র, তাহাতে সংশয় নাই। তাঁহার মতে, চিনা কমিউনিস্ট পার্টিই ভবিষ্যতে অবান্তর ও নিশ্চিহ্ন হইয়া যাইবে, যদি এখনই দ্রুতবর্ধমান দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের প্রবণতা কঠোর হস্তে রোধ করা না যায়। কিন্তু দুর্নীতির উৎসে যাওয়ার চেষ্টা তিনি করেন নাই। সরকারি ক্ষেত্রে দুর্নীতির মতো যথেচ্ছাচার তখনই সম্ভব হয়, যখন গণ-নজরদারির বন্দোবস্ত না থাকে। চিনে প্রথমাবধি যে একদলীয় শাসন কায়েম, তাহা সেই নজরদারির সুযোগ দেয় না। কেবল পার্টির কাছে, সংশ্লিষ্ট পার্টি কমিটির কাছে গ্রাহ্য ও সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারিলেই হইল। বেসরকারি কোনও গণমাধ্যম না থাকায় দুর্নীতির সংবাদ সাধারণ্যে ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না। দুর্নীতি তাই অবাধ হইতে পারে, যত ক্ষণ না পার্টির উচ্চতর কিংবা শীর্ষ নেতৃত্ব তাহা দমনে অগ্রসর হয়। সে ক্ষেত্রেও প্রায়শ বিরুদ্ধ গোষ্ঠীকে কোণঠাসা করিতে দুর্নীতির উন্মোচন ও তদন্তের আশ্রয় লওয়া হয়। উপর হইতে একতরফা ভাবে গৃহীত স্বচ্ছতার নীতি তাই অনেক সময় প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের বহিষ্কারের হাতিয়ারও হইয়া ওঠে।
বস্তুত, একদলীয় শাসনের স্বৈরাচারের মধ্যেই দুর্নীতির বীজ উপ্ত থাকে। গণতন্ত্রে বহুদলীয় ব্যবস্থায় জনাদেশ লইয়া শাসকদের ক্ষমতায় আসিতে হয়, নির্বাচকমণ্ডলী বিরূপ হইলে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকদের প্রত্যাখ্যাত হওয়ার শঙ্কাও বিলক্ষণ। সংবাদপত্র, বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম সর্বত্র শ্যেনচক্ষু মেলিয়া রাজনীতিকদের, ক্ষমতাধর আমলাদের প্রতিটি পদক্ষেপের উপর সন্ধানী আলো ফেলে। শি চিনফিং চিনকে কোনও বহুদলীয় গণতন্ত্র উপহার দিবেন, এ সম্ভাবনা নাই। তিনি বড় জোর দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক ও আমলাদের একটি ক্ষুদ্র অংশকে তদন্ত ও বিচারের আওতায় আনিবেন। এই প্রয়াস সাধু হইলেও খণ্ডিত। ইহাতে দলের ভিতর তাঁহার প্রাধান্য আরও নিরঙ্কুশ হইবারই সম্ভাবনা। সত্যই দুর্নীতি দমনের মহাযজ্ঞে নামিতে হইলে তাঁহাকে আরও গোড়ার কাজটি অর্থাৎ এক-পার্টি-তন্ত্রের সংস্কারটিই আগে সারিতে হইত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy