শিকড়ে ফিরিবার নীতিটি শুনিতে মহৎ, পালন করা কঠিন। প্রথমেই জানিতে হইবে, শিকড় কাহাকে বলে, যাহাকে শিকড় বলিব তাহাকে কেন শিকড় বলিব, যাহা শিকড় বলিয়া বিবেচিত হইবে না তাহা কোন যুক্তিতে বাদ পড়িবে ইত্যাদি। এই গেছোদাদা-সুলভ সংকটে পড়িয়াছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। একটি জনস্বার্থ মামলার সূত্রে দাবি উঠিয়াছে, ‘ইন্ডিয়া তথা ভারত’-এর যুগলতা বর্জন করিয়া ভারত বা ভারতবর্ষ নামটিকেই একক ভাবে স্বীকার করা হউক, সরকারি ও বেসরকারি সকল ক্ষেত্রে। বিপাকে পড়িয়া সুপ্রিম কোর্ট প্রতিটি রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মতামত জানিতে চাহিয়াছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে নাম-পরিবর্তন আইন তৈরি সঙ্গত হইবে কি না, সেই প্রশ্নে রাজ্যগুলিকে ভোট দিতে বলিয়াছে। বাস্তবিক, প্রশ্নটি নিছক নাম পরিবর্তনের, না কি সংবিধান সংশোধনের ইঙ্গিতও প্রচ্ছন্ন? সংবিধানের প্রথম ধারার প্রথম অনুচ্ছেদেই বলা হইয়াছে, ইন্ডিয়া তথা ভারত তাহার অন্তর্গত প্রদেশগুলির ইউনিয়ন। ইহার মধ্যে যে স্বাভাবিক দুই-নামের স্বীকৃতি আছে, এই আবেদনে তাহা খারিজ করিবার দাবিও নিহিত। একটি বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নাই: এই দাবি কেবল দ্বিত্ব বর্জনের অভীপ্সায় প্রস্তাবিত হয় নাই। ভারত-এর পক্ষে কেন ভোট দেওয়া উচিত, তাহা স্পষ্ট উল্লিখিত হইয়াছে: ইন্ডিয়া নামের উৎস, সূত্র ও হেতু সবই বিদেশি, সুতরাং ইহা সমূলে বর্জনীয়, ভারত নামটি বেশি প্রাচীন, তাই বেশি গ্রহণযোগ্য।
ইন্ডিয়া-র শিকড়যোগ্যতা (অর্থাৎ প্রাচীনতা) ভারত অপেক্ষা কেন কম? ভারত শব্দটি ভরত-বংশীয় উত্তরাধিকারের অর্থে প্রাচীন ভারতের মহিমা বহন করে, সকলেই জানেন। সেই ভরত যদি ঋগ্বেদে বর্ণিত রাজাই হন, তবে তাঁহার প্রাচীনতা লইয়া প্রশ্ন উঠিতে পারে না। কিন্তু উত্তরাধিকার-সূত্রে কোন অঞ্চলটিকে বুঝানো হইতেছে, তাহা লইয়া প্রশ্ন চলিতে পারে। বায়ুপুরাণের যে ভারতবর্ষ, সে বিষয়েও একই প্রশ্ন। আর, প্রাচীনতাই যদি একমাত্র বিবেচ্য হয়, তবে জম্বুদ্বীপই বা বাদ যায় কেন? এ দিকে ইন্ডিয়া-র মূলে যে গ্রিক ইন্ড্ কিংবা পারসিক ইন্ডোস, তাহাও খ্রিস্টের জন্মের অনেক আগেকার কথা, সুতরাং প্রাচীনতার দাবিতে ইন্ডিয়া যথেষ্ট বলীয়ান। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস যে ইন্ড-এর কথা লিখিয়া গিয়াছিলেন, তাহার আঞ্চলিকতার সীমা-পরিসীমাও স্পষ্টতর। কেহ বলিতে পারেন, সিন্ধুনদী কিংবা সিন্ধুপ্রদেশ সবই যখন আপাতত পাকিস্তানে, ইন্ডিয়ার শীঘ্র ভারত হইয়া যাওয়াই মঙ্গল। নিশ্চয়ই। তবে, সে ক্ষেত্রে হিন্দুদেরও নিজেদের জন্য একটি বিকল্প নাম ভাবিলে ভাল হয়। ইন্ডিয়া যদি যবন-স্পর্শে বাদ যায়, হিন্দু-ই বা আর বাকি থাকে কেন?
প্রশ্ন আরও একটি। দুইটি নামের সমস্যা কি এত বড় সমস্যা যে দেশের সর্বোচ্চ আদালত, দেশের কেন্দ্রীয় আইনসভা, দেশের প্রতিটি রাজ্য, সকলকে এখন সমস্যা সমাধানের জন্য চুলচেরা ভাবনায় বসিতে হইবে? সমস্যারও তো একটি শ্রেণিবিভাগ কিংবা উচ্চাবচতার বিষয় রহিয়াছে। খুঁজিলে এই গ্রহে আরও বেশ কয়েকটি দেশ পাওয়া যাইবে না কি যাহাদের একই ধরনের সমস্যা রহিয়াছে? তাহাদের মধ্যেও হয়তো এই লইয়া আলোচনা হইয়া থাকে। কিন্তু সম্ভবত সে সব আলোচনা সামাজিক পরিসরেই আবদ্ধ থাকিয়া যায়। আইনবিভাগ বা বিচারবিভাগের সামনে জ্বলন্ত সংকট হইয়া উঠে না। ইন্ডিয়া, থুড়ি, ভারত, কি সংকটের বিহ্বলতায় লঘু-গুরু জ্ঞান হারাইয়াছে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy