পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা আর প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদাটুকুও পাইতেছেন না, এ কে গোপালন ভবনের নিকট ইহা গৌণ সমস্যা। মুখ্য প্রশ্ন হইল, এখন তাঁহাদের রাজনৈতিক পরিচয় কী? বিপ্লব আসিতেছে না। আজও নহে, পরশুর পরের দিনও নহে। অনুদানের রাজনীতিটিকেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গিলিয়া ফেলিয়াছেন। বামপন্থী রাজনীতি বলিতে আগে যাহা বুঝাইত, এখন তাহার সর্বাঙ্গে ঘাসফুল আঁকা। অতএব, পড়িয়া থাকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা। ধর্মতলার মোড় অবরোধ করিয়া কালো হাত ভাঙিয়া, গুঁড়াইয়া দেওয়ার নির্ঘোষ। মুশকিল হইল, সেই মাও ৎসে তুঙ-ও নাই, সেই যাটের দশকও নাই। একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের তরুণ প্রজন্ম মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার বাঁশি শুনিয়া বিমান বসুদের পিছন পিছন চলিতে থাকিবে, এমন কল্পনা দস্যু মোহনের গল্পকেও দশ গোল দিবে। নিজেদের বলিয়া দাবি করিবার মতো কোনও গ্রহণযোগ্য রাজনীতির অভাবই আজ বামপন্থীদের অস্তিত্বের সংকট তৈরি করিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ফলাফল তাহারই দ্যোতক। কেরলেও যে বিজেপি দশ শতাংশ ভোট পাকা করিয়া ফেলিয়াছে, তাহা বামপন্থী রাজনীতির ভূমিক্ষয়েরই নির্দেশক। তরুণ প্রজন্মের নিকট হিন্দুত্বগন্ধী জাতীয়তাবাদী উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিও বাম রাজনীতির তুলনায় আকর্ষণীয় ঠেকিতেছে।
সীতারাম ইয়েচুরিদের পক্ষে একটিই আশার কথা, তাঁহাদের আর হারাইবার মতো কিছু নাই। পশ্চিমবঙ্গ গিয়াছে; কেরল থাকিবে, সেই নিশ্চয়তা নাই; বিহার, ওডিশা বা অন্ধ্রপ্রদেশের ন্যায় রাজ্য হইতে বামপন্থীদের চিহ্ন অতি দ্রুত মুছিয়া যাইতেছে। ত্রিপুরার আঞ্চলিক দলের গৌরবটি এড়াইতে চাহিলে, অতএব, নিজেদের নূতন করিয়া পাইবার একটি চেষ্টা তাঁহারা করিয়া দেখিতে পারেন। তাহার জন্য কতগুলি অপ্রিয় সত্যকে স্বীকার করিয়া লইতে হইবে। তাঁহারা সম্ভবত মিলন কুন্দেরার উপন্যাস পড়েন না। অশীতিপর চেক লেখকের সাম্প্রতিকতম উপন্যাসটি পড়িলে তাঁহারা জানিতেন— মৃত মানুষ ক্রমে প্রাচীন মৃতে পরিণত হয়, এবং প্রাচীন মৃত শেষ অবধি পুতুল হইয়া যায়, যাহার নাম ভিন্ন আর কোনও তাৎপর্য অবশিষ্ট থাকে না। আলিমুদ্দিনের কুলুঙ্গিতে অধিষ্ঠিত লেনিন-স্তালিন সেই পুতুলের স্তরটিও প্রায় অতিক্রম করিয়া ফেলিয়াছেন। তাঁহাদের হাত ধরিয়া ভারতীয় রাজনীতির বৈতরণী পার হওয়া অসম্ভব। দ্বিতীয় কথা, ‘সর্বহারা’-র একচেটিয়া অধিকার বেদখল হইয়া গিয়াছে। তাঁহাদেরই খেলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহাদের দশ উইকেটে হারাইয়াছেন। এখন তাঁহারা মূলত মধ্যবিত্তের দল। অতএব, দলের রাজনীতিকে সেই ছাঁচে ঢালিয়া লইতে হইবে। তাহার জন্য গরিব-বিদ্বেষী নীতির প্রয়োজন নাই, কিন্তু উন্নয়নের একটি বিকল্প ভাষ্য ভিন্ন এই রাজনীতি করা অসম্ভব।
বামপন্থীদের নিকট রাতারাতি দক্ষিণপন্থী হইয়া উঠিবার দাবি নাই। কিন্তু, দলের অবস্থানে মধ্যবিত্তের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন না ঘটিলে তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করাও অসম্ভব। তাঁহারা পুনর্বণ্টনের অর্থনীতিতেই ভরসা রাখুন— কিন্তু তাহার জন্য গোড়ায় শিল্প প্রয়োজন, বিনিয়োগ প্রয়োজন। শিল্পের নিজস্ব দাবিদাওয়াগুলি মানিয়া লইতে হইবে। বিনিয়োগের রঙ বাছাই, অথবা শ্রম আইন লইয়া অনড় অবস্থান তাঁহাদের রাজনীতির পক্ষে ক্ষতিকারক। ভারতীয় বামপন্থীরা টোনি ব্লেয়ারকে আদর্শ মানিতে পারেন। লেবার হইতে নিউ লেবারে সরিয়া আসিবার প্রক্রিয়াটি শিক্ষণীয়। ঘরেই উদাহরণ আছেন: বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য । বামপন্থীরা নিজেদের অবস্থান লইয়া ভাবুন। তাহারও পূর্বে ভাবুন, নেতৃত্বে নূতন মুখ তাঁহারা কোথা হইতে আনিবেন। পুরাতন মুখে নূতন সংকল্প মানুষের নিকট বিশ্বাসযোগ্য ঠেকিবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy