সহসা মধ্যমণি। সিবিআই হানার পরে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল। ১৫ ডিসেম্বর। ছবি: পিটিআই।
ম ঙ্গলবার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালকে তাঁর অফিসে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, কারণ তাঁর সরকারের এক প্রবীণ আধিকারিকের দুর্নীতির অভিযোগে সিবিআই হানা দিয়েছিল। দৃশ্যত প্রতিহিংসামূলক এমন একটা আচরণ নরেন্দ্র মোদীর সরকার কেন করল? আপাতদৃষ্টিতে এ তো রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল। দিল্লি সরকারের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি রাজেন্দ্র কুমারের অফিসে এবং বাসস্থানে অনুসন্ধানের সঙ্গত কারণ থাকুক বা না-ই থাকুক, এই হানাদারির কল্যাণে মোদী সরকার কেজরীবালকে হিরো বানিয়েই ছাড়বে, এমন সম্ভাবনা জোরদার। প্রশ্ন হল, কেন তারা এটা করল?
তর্কের খাতিরে আপাতত ধরে নেওয়া যাক, সংশ্লিষ্ট অফিসার ভয়ানক দুর্নীতিগ্রস্ত। কিন্তু তা হলেও কি এটাই সকলের চোখে সবচেয়ে বড় ব্যাপার বলে গণ্য হবে যে, কেজরীবাল এক জন দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসারকে আড়াল করছেন? এক জন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে নিজের অফিসে ঢুকতে দেওয়া হল না, তার চেয়েও বড় ব্যাপার? ধরা যাক, প্রধানমন্ত্রীর অফিসে (পিএমও) কর্মরত কোনও অফিসারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে সিবিআই হানা দিতে চাইল। তখন কি পিএমও বন্ধ করে দেওয়া হবে? এক ঘণ্টার জন্যও?
ন্যাশনাল হেরাল্ড সংক্রান্ত মামলায় আদালতের নির্দেশকে উপলক্ষ করে কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট সনিয়া ও রাহুল গাঁধীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মোদী সরকার সম্পর্কে, কিন্তু এই একটি ঘটনা ভারতীয় জনতা পার্টির রাজনৈতিক বিরোধীদের এতটাই সতেজ করে তুলেছে, যা রীতিমত অকল্পনীয় ছিল। কিছু কিছু কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলার চেষ্টা করছেন যে, সিবিআই কী করছে না করছে, সে ব্যাপারে সরকারের কোনও হাত নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর অতি বড় অনুরাগীরাও এ কথা বিশ্বাস করবেন বলে মনে হয় না।
তবু, ধরে নেওয়া গেল, সিবিআইয়ের অধিকর্তা অনিল সিংহের কথাই সত্যি, বিজেপির কোনও মন্ত্রী বা মোদী সরকারের কোনও কর্তাব্যক্তি তাঁকে বা তাঁর কোনও অফিসারকে এ বিষয়ে ফোনে কোনও নির্দেশ বা পরামর্শ দেননি। কিন্তু পুলিশি তদন্তের ক্ষেত্রে দেশের এক নম্বর প্রতিষ্ঠানটি সম্বন্ধে নাগরিকদের যা ধারণা, তাতে এ কথা কেউ বিশ্বাস করতে পারবেন? মোদীর দুর্ভাগ্য, পারবেন না।
প্রাসঙ্গিক এক জনের সঙ্গে আমার এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা হয়েছে। এই শর্তে তিনি কথা বলেছেন যে, সমস্ত কথা সম্পূর্ণ গোপন থাকবে। সেই আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার যে, এই ঘটনার রাজনৈতিক অভিঘাত সামলানো মোদী সরকার এবং বিজেপির সামনে খুব কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে গুরুত্বপূর্ণ বিলগুলি পাশ করানোর ব্যাপারে সরকার যে হাল ছেড়ে দিয়েছে, সেটা অরুণ জেটলির কথা থেকেই বোঝা গেছে: ১৪ ডিসেম্বর এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এই অধিবেশনটি তো ভেসেই গেল (ওয়াশআউট)।
সরকার এবং বিজেপির মুখপত্ররা সাফাই হিসেবে যা বলছেন, তার বাইরে আর কী বলতে পারেন, আমি যাঁর সঙ্গে কথা বললাম, তিনি সে বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত দিলেন। এক, তাঁরা হয়তো বলবেন, নিজের লোকদের কারও বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলে দল কড়া ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করে না। দৃষ্টান্ত: মধ্যপ্রদেশের ব্যপম কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত রাজ্যের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী লক্ষ্মীকান্ত শর্মাকে জুলাই মাসেই গ্রেফতার করা হয়েছিল। দুই, রাজ্য সরকারি অফিসারের বিরুদ্ধে সিবিআই হানার ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীকে আগাম জানানো হয়নি, এটা কোনও অস্বাভাবিক বা অভূতপূর্ব ঘটনা নয়। গত সেপ্টেম্বর মাসে রাজস্থানের খনি মন্ত্রকের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি অশোক সিংভিকে গ্রেফতারের আগে বসুন্ধরা রাজে সে বিষয়ে কিছু জানতেন না। তিন, কোনও মুখ্যমন্ত্রীর কোনও গুরুত্বপূর্ণ আমলার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে হানাদারির সময় মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নির্ধারিত প্রাসঙ্গিক ফাইলও সিবিআই দেখেই থাকে, সে ফাইল তাঁর অফিসে থাকলেও। এই অবধি বলে তিনি আর কোনও যুক্তি খুঁজে পাননি।
বাংলায় একটা কথা আছে: কেঁচো খুঁড়ে গিয়ে সাপ বেরোনো। মুখ্যমন্ত্রী কেজরীবালের অফিসে সিবিআই হানার পরিণাম দেখে কথাটা মনে পড়তে বাধ্য। সমস্ত বিরোধী দল যে ভাবে মোদী সরকারের, বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির বিরোধিতায় সমবেত হয়েছে। রাজেন্দ্র কুমারের মতোই অরুণ জেটলি সম্পর্কে অভিযোগগুলিও কয়েক বছরের পুরনো। কিন্তু প্যান্ডোরার বাক্স এক বার খুললে যত রাজ্যের ভূতপ্রেত বেরিয়ে আসে, সে তো জানাই আছে। যদি ধরে নিই, সিবিআই কী করতে যাচ্ছে সেটা মোদী জানতেন, তা হলে প্রশ্ন উঠবেই: তিনি কি এর পরিণাম অনুমান করতে পেরেছিলেন? সম্ভবত না।
লক্ষণীয়, এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে অরুণ জেটলির তফাত কী? দু’জনের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির ব্যাপারে চোখ বুজে থাকার অভিযোগ উঠেছে। জেটলির ক্ষেত্রে একটা বাড়তি প্যাঁচ আছে— দিল্লি ডিস্ট্রিক্ট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (ডিডিসিএ)-এর উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থাকার সময় তিনি এই প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে নিষ্ক্রিয় ছিলেন, এই কথাটি যিনি জনসমক্ষে প্রথম বলেছেন, তিনি এক জন ভূতপূর্ব ক্রিকেট খেলোয়াড় এবং অর্থমন্ত্রীর দলেরই সাংসদ, অর্থাৎ নানা অর্থেই তাঁর সতীর্থ। তাঁর নাম কীর্তি আজাদ।
বিজেপির অন্দরমহলেও অনেকেরই আশঙ্কা, কেজরীবালের অফিসে এই কাণ্ডের ফলে ব্যাপারটা এখন ভয়ানক ভাবে ‘আমরা বনাম ওরা’ দাঁড়িয়ে গেছে: এক দিকে বিজেপি ও এনডিএ’তে তার কিছু শরিক, অন্য দিকে কার্যত আর সবাই। এমনকী যারা পরস্পরের চরম বিরোধী— যেমন সিপিআইএম এবং তৃণমূল, কিংবা সমাজবাদী পার্টি এবং বহুজন সমাজ পার্টি— তারাও এই প্রশ্নে এক হয়ে গেছে। মোদী সরকারের পক্ষে এটা কেবল দুঃসংবাদ নয়, অত্যন্ত বিস্ময়করও বটে। কংগ্রেস, বামপন্থীরা ও বিএসপি যখন অভূতপূর্ব রকমের দুর্বল, তেমন একটা সময়ে ভারতের দ্বন্দ্বমুখর এবং ছত্রভঙ্গ বিরোধী শিবিরকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছেন মোদী ও তাঁর সহকর্মীরা, এ বড় সহজ কথা নয়!
১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসে মোরারজি দেশাই সরকার (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন চরণ সিংহ) ইন্দিরা গাঁধীকে গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই সিদ্ধান্ত শ্রীমতী গাঁধীর পক্ষে পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি জামিন নিতে অস্বীকার করেন, অন্তত একটা রাত্রি বন্দি থাকার জন্য জোর করেন। এই গ্রেফতারের ঘটনাটিকে তিনি পরে দারুণ ব্যবহার করেছিলেন, নিজেকে এক জন রাজনৈতিক শহিদ হিসেবে জনসাধারণের কাছে প্রতিপন্ন করতে পেরেছিলেন। ইন্দিরা গাঁধী অনেককেই বিশ্বাস করাতে পেরছিলেন যে, জরুরি অবস্থার সময় তাঁর নামে অন্যরা যে সব ‘বাড়াবাড়ি’ করেছে, সেগুলির জন্য তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। গ্রেফতারের ফলে তিনি এই ধারণাটি প্রচারের সুযোগ পান যে— সবাই আমার সঙ্গে শত্রুতা করছে। এই থেকেই তাঁর রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের সূচনা হয়। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে ১৯৮০ সালে তিনি আবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন।
এই মুহূর্তের ঘটনাচক্র দেখে মনে হচ্ছে, ইন্দিরা গাঁধীর পুত্রবধূ এবং পৌত্র দু’জনেই আগামী কাল, শনিবার ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলায় আদালতে গিয়ে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy