Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

মানবজমিন

সত্যজিত্‌ চক্রবর্তী নামক কলিকাতানিবাসী এক নাগরিক সোমবার প্রত্যূষে যাদবপুর অঞ্চলের সুকান্ত সেতুর উপর এক নবজাতকের কান্নার আওয়াজ পাইয়া থমকাইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। একটি প্লাস্টিকের থলির মধ্যে রাখা ওই নবজাতকটিকে একটি কাক ঠোকরাইতেছিল। সত্যজিত্‌বাবু নবজাতকটিকে উদ্ধার করেন, কয়েক জন মহিলাকে সাহায্য করিতে ডাকিয়া আনিয়া একটি হাসপাতালে ভর্তি করান।

শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

সত্যজিত্‌ চক্রবর্তী নামক কলিকাতানিবাসী এক নাগরিক সোমবার প্রত্যূষে যাদবপুর অঞ্চলের সুকান্ত সেতুর উপর এক নবজাতকের কান্নার আওয়াজ পাইয়া থমকাইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন। একটি প্লাস্টিকের থলির মধ্যে রাখা ওই নবজাতকটিকে একটি কাক ঠোকরাইতেছিল। সত্যজিত্‌বাবু নবজাতকটিকে উদ্ধার করেন, কয়েক জন মহিলাকে সাহায্য করিতে ডাকিয়া আনিয়া একটি হাসপাতালে ভর্তি করান। নবজাতকটি প্রায় মুমূর্ষু দশা হইতে প্রাণের স্পন্দিত আলোয় ফিরিয়াছে। সত্যজিত্‌বাবু এবং হাসপাতালের চিকিত্‌সকদের প্রচেষ্টায় এই অজ্ঞাতকুলশীল, অসহায়, পরিত্যক্ত শিশুটি অন্তত প্রাণে বাঁচিয়া গেল। পিতৃমাতৃপরিচয়হীন এই পরিত্যক্ত শিশুর ভবিষ্যত্‌ কেমন হইবে, ভাবী কালের গর্ভেই তাহার উত্তর রহিয়াছে। কিন্তু এক মহানুভবের চেষ্টায় সে যে আদৌ অতীত হইতে ফিরিয়া ভবিষ্যতের অভিমুখী হইতে পারিল, তাহাতে সংশয় নাই।

সত্যজিত্‌বাবু প্লাস্টিকের থলিটি দেখিয়াও না-দেখিবার ভান করিতে পারিতেন, যেমন অনেকেই করিয়া থাকে। তিনি নবজাতকের ক্রন্দনধ্বনি শুনিয়াও পাশ কাটাইয়া আপন প্রাতর্ভ্রমণ সম্পাদনে ধাবিত হইতে পারিতেন, যেমন অনেকেই হইত। ‘কে আবার উটকো ঝামেলায় জড়ায়’ ভাবিয়া তিনি জাগ্রত বিবেক ও মনুষ্যত্বের তাড়নার টুঁটি টিপিয়া ধরিতে পারিতেন, যেমনটা অনেকেই ধরিত। কিন্তু তিনি দায় এড়াইলেন না। এক জন যথার্থ মানুষের মতো কর্তব্যপরায়ণ হইয়া উঠিলেন। এবং সত্যজিত্‌বাবু তাঁহার এই কৃতকর্মের জন্য অতিরিক্ত কোনও শ্লাঘা বোধ করিতেছেন না। ইহাকে তিনি পরোপকার বলিয়াও মনে করেন না। আর্তত্রাণে তাঁহার নিজের ভূমিকাকে অনেক পাঁচ সিকার রাজনীতিকের মতো ঢাক পিটাইয়া প্রচার করিতেও তাঁহার রুচিতে বাধে। নিতান্ত সহজ, স্বাভাবিক ভাবেই তিনি বলিয়াছেন-- নাগরিক হিসাবে তিনি তাঁহার কর্তব্য করিয়াছেন মাত্র, আর এই করার মধ্যে কোনও বাহাদুরিও নাই। তাঁহার কাছে শিশুটিকে হাসপাতালে লইবার মতো পর্যাপ্ত টাকা ছিল বলিয়াই তিনি নির্দ্বিধায় তাহাকে হাসপাতালে লইয়া যান। সত্যজিত্‌বাবুর এই সহজ মানবতা হাসপাতালের চিকিত্‌সক ও পরিচালকমণ্ডলীকেও স্পর্শ করিয়াছে। শহরের যথেষ্ট দামি হাসপাতাল বলিয়া পরিচিত হইলেও তাঁহারা নবজাতকটির চিকিত্‌সা বাবদ কোনও অর্থ লন নাই। এক জন মহাপ্রাণের মমতা ও মানবিকতা অন্যদের মানবিকতাকেও অন্তরের অন্তঃস্থল হইতে বাহির করিয়া আনে। দুরাচার যেমন ছোঁয়াচে, সদাচারও বোধ করি তেমনই।

এই অদ্ভুত তমসায় এই সব মানুষ হয়তো নিতান্তই ব্যতিক্রমী। ব্যতিক্রমী, কিন্তু একেবারে বিরলও নহেন। বিরল নহেন বলিয়াই হয়তো এই জগত্‌সংসার এখনও চলিতেছে, মুখ থুবড়াইয়া পড়ে নাই, উচ্ছন্নে যায় নাই। নহিলে উচ্ছন্নে যাওয়ার যাবতীয় উপকরণই তো মজুত। স্বার্থপরতা, ক্ষমতালিপ্সা, পরশ্রীকাতরতা, মিথ্যাচার, হিংসাশ্রয়ী রাজনীতি, রাজনৈতিক সন্ত্রাসদীর্ণ স্বৈরাচার সমাজের যাবতীয় মূল্যবোধ, তাহার গোষ্ঠীগত মগ্নচৈতন্যের অবনমনের ক্রিয়ায় ব্যক্তিমানুষের মনুষ্যত্বও খর্ব করিয়া চলিয়াছে। তবু যে এই গ্রহ এখনও মানুষের বাসযোগ্য রহিয়াছে, তাহা কেবল এই ধরনের সুমানবদের জন্যই। তাঁহারা আছেন বলিয়াই এখনও মরণাপন্ন শিশুরা পৃথিবীর আলো দেখিতে পায়। কৃষিকাজ ভুলিয়া যাওয়া বঙ্গীয় সমাজ যদি এমন মানবজমিনই আবাদ করিতে পারিত!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE