আর শিশুটি?
দেশের শীর্ষ আদালতের রায়ে এখন কোনও অবিবাহিত মা একাই সন্তানের পূর্ণ অভিভাবক হতে পারবেন। (আবাপ, ৭-৭) মহিলারা এখন পুরুষের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে সবক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছেন। পিতা, স্বামী বা সন্তানের উপর তাঁদের নির্ভরশীলতা ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে। এমতাবস্থায়, এই রায় অবশ্যই স্বাগত।
তবু কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। এক জন স্বাবলম্বী শিক্ষিত মহিলা পুরুষের সাহায্য ছাড়া মা হতেই পারেন। কিন্তু যদি উল্টো দিকে ভাবি, এই শিশু কি তার বাবা ছাড়া সারাজীবন কাটাতে রাজি ছিল? শিশুটির মতামতের কি কোনও মূল্যই নেই? কেন এক জন নারীর ইচ্ছা বা শখ চরিতার্থ করার জন্য তাকে সারা জীবন বাবার আশ্রয়, বাবার পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হতে হবে? সে কোনও দিন কাউকে বাবা বলে ডাকতে পারবে না। যখন সে স্কুলে যাবে, বন্ধুদের বাবার সঙ্গে দেখলে বা বাবার বিষয়ে আলোচনা হলে তার মনের কী অবস্থা হবে? পেরেন্টস মিটিং বা কোনও অনুষ্ঠানে বাবা-মায়ের সঙ্গে বন্ধুদের দেখে তার কি কোনও কষ্ট হবে না? একাকী সাহসী মায়ের জন্য গর্ব করার মতো মানসিকতা নিয়ে কি সে জন্ম নিয়েছে।
সন্তানের বড় হওয়ার ক্ষেত্রে বাবা মা দুজনেরই উপস্থিতি ভীষণ প্রয়োজন। অন্তত আমাদের সামাজিক পরিস্থিতিতে। বিশেষ ক্ষেত্রে কোনও বাবা যদি দায়িত্ব না নিতে চায় তবে সন্তানের মঙ্গলের জন্য তাকে জোর করে ধরে রাখার কোনও মানে নেই, অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে মাকেই পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে। তবে সন্তান জানবে তার বাবা আছে, কিন্তু সে আর সবার বাবার মতো নয়, তাই মায়ের আশ্রয়ে সুখী থাকবে বা থাকার চেষ্টা করবে। বাবার অভাব তাকে কষ্ট দেবে ঠিকই, কিন্তু পিতৃপরিচয় নেই, এই ভাবনায় সারা জীবন তাকে হাহাকার করতে হবে না। আইন অবশ্যই তখন মাকে সমর্থন করবে জন্মদাতা বাবার উপস্থিতি উপেক্ষা করেই।
নারী স্বাধীনতার অর্থ কোনও শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে ছেলেখেলা করা নয়। আমি স্বাধীন, তাই আমি আইভিএফ পদ্ধতিতে কুমারী মা হব, অর্থাৎ একটা মানুষকে অর্ধেক পরিচয়ে সারা জীবন কাটাতে বাধ্য করব— এটা কোনও সুস্থ চিন্তা হতে পারে না। এক জন নারী তাঁর জীবনে পুরুষসঙ্গী বা স্বামীর অস্তিত্ব স্বীকার না করতেই পারেন, কিন্তু সে জন্য একটা শিশুকে তার বাবার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হবে কেন?
একটু ভেবে দেখা দরকার, কারও শখ চরিতার্থ করার জন্য কোনও জীবন এ ভাবে বলি দেওয়া সমর্থনযোগ্য কি না।
সীমা চৌধুরী। কলকাতা-৭৮
আমাদের অভিজ্ঞতা
পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাটি (‘কোনখানে মা...’, রবিবাসরীয়, ৫-৭) পড়লাম। আমি অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষিকা। দেরি করে বিয়ে করেছিলাম। যখন বুঝলাম নিজে মা হতে পারব না, সিদ্ধান্ত নিলাম দত্তক নেব। খবরাখবর করে সোজা চলে গেলাম মাদার টেরিজার নির্মলা শিশু ভবনে, দত্তক বিভাগে। দু’মাসের মধ্যেই সমস্ত ব্যবস্থা হল।
এই ঘটনায় শহরে মোটামুটি একটা সাড়া পড়ে গেল। স্থানীয় সাংবাদিকরা, সহকর্মীরা, আরও কত লোক যে মেয়েকে দেখতে এল। আমার সহকর্মী অধ্যাপিকা, আরও তিন চারটি দম্পতি মাদার টেরিজার কাছ থেকে দত্তক গ্রহণ করেছিল। তাদের এক জন ডাক্তারি পাস করে চাকরি করছে। এক জন সফ্টওয়্যারে কাজ করছে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত। এখনও বহু দম্পতি আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে আসেন।
ঠিক করেছিলাম, মেয়ের বোঝার বয়স হলেই জানিয়ে দেব আমরা ওর জন্মদাতা নই। কিন্তু ওর মা-বাবা আমরাই। সেটা ও সহজ ভাবেই গ্রহণ করেছে। মাদার টেরিজাকে নিজের ঠাকুমা দিদিমার মতোই মনে করে।
তিন বছর বয়সে ওকে নার্সারিতে ভর্তি করিয়ে দিলাম। কিন্তু ২-৩ বছরের মধ্যেই বুঝতে পারা গেল যে, ওর স্বাভাবিক শিক্ষা গ্রহণ করার ক্ষমতার ঘাটতি আছে। দিদিমণিরা ও ক্লাসের বন্ধুরা ওকে খুব ভালবাসত। ও শিক্ষা যতটা নিতে পারল নিল, পাশাপাশি ওর যেগুলোয় আগ্রহ— গান, নাচ, ছবি আঁকা, রান্নাবান্না, এ সব শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলাম। অন্যের ব্যাপারে ও খুবই অনুভূতিপ্রবণ। তিন বছর হল আমরা ওর বিয়ে দিয়েছি। সে আজ একটি দেড় বছরের ফুটফুটে মেয়ের আত্মবিশ্বাসী মা।
দত্তককে মা-বাবা ও পরিবার যদি আপন করে নেয়, সমাজও নেবে। আমাদের অভিজ্ঞতা, ভাল কাজ করলে সমর্থন করার মতো অনেক উদার মানুষ সমাজে আছেন।
সুমিত্রা দে। প্রতাপবাগান, বাঁকুড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy