Advertisement
০৮ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

হাস্যরস, নির্মল নয়

লঘুক্রিয়া’ বলিলেও যদি কোনও ক্ষেত্রে অতিশয়োক্তির দোষ হয়, তবে তাহা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক ভূমি সংস্কার আইন সংশোধন। পশ্চিমবঙ্গের জন্য যাহা প্রয়োজন ছিল, আর মুখ্যমন্ত্রী যাহা করিয়াছেন, উভয়ের মধ্যে সিবিআই-রাজ্য পুলিশের ব্যবধান। লোক হাসানো ভিন্ন এই সংস্কারের আর কোনও উপযোগিতা আছে বলিয়া দাবি করা কঠিন।

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

লঘুক্রিয়া’ বলিলেও যদি কোনও ক্ষেত্রে অতিশয়োক্তির দোষ হয়, তবে তাহা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক ভূমি সংস্কার আইন সংশোধন। পশ্চিমবঙ্গের জন্য যাহা প্রয়োজন ছিল, আর মুখ্যমন্ত্রী যাহা করিয়াছেন, উভয়ের মধ্যে সিবিআই-রাজ্য পুলিশের ব্যবধান। লোক হাসানো ভিন্ন এই সংস্কারের আর কোনও উপযোগিতা আছে বলিয়া দাবি করা কঠিন। জমির ঊর্ধ্বসীমা যেমন ছিল, তেমনই থাকিতেছে। শিল্পের জন্য ২৪ একরের বেশি জমি প্রয়োজন হইলে সরকারি অনুমতিও অপরিহার্য থাকিল। শুধু, আরও কয়েকটি ক্ষেত্র বাছিয়া লওয়া হইয়াছে, যেগুলিতে এই ছাড় দেওয়া হইবে। জমি হাতে পাওয়ার পর তিন বত্‌সর নহে, পাঁচ বত্‌সরের মধ্যে শিল্প গড়িয়া ফেলিতে হইবে। এই বাড়তি দুই বত্‌সর সরকারের আর এক বদান্যতা। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস নামক দলটি বিরোধী ও শাসক অবতারে জমি বিষয়ক যে কুনাট্যটি প্রযোজনা করিয়া আসিয়াছে, এই সংশোধনীকে তাহার নবতম অঙ্ক বলা চলে। তাঁহাদের নিকট ভোট অপেক্ষা জরুরি আর কিছু নাই। তবে, দলনেত্রী সময় পাইলে নিজেকে একটি প্রশ্ন করিয়া দেখিতে পারেন: শিল্প না আসিলে, কর্মসংস্থান না হইলে, জমি লইয়া নেতিবাচক রাজনীতি তাঁহাদের পরবর্তী নির্বাচন পার করাইতে পারিবে তো?

প্রশ্নটির উত্তর কালীঘাটের জানা বলিয়াই অনুমান করা চলে। সরকারের মেয়াদের তিন-চতুর্থাংশ অতিক্রম করিয়া এখন শিল্প টানিবার মরিয়া প্রচেষ্টা চলিতেছে। কিন্তু, শিল্প আসিবে কীসের ভরসায়? আইনের শাসনের কোনও সম্ভাবনা তাঁহারা আর রাখেন নাই। এহেন রাজ্যে জমির জন্যও যদি নবান্নের অনুগ্রহের অপেক্ষায় থাকিতে হয়, কেহ পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করিতে চাহিবেন কেন? দেশের আর কোথাও এমন বিচিত্র আইন নাই যে সামান্য ২৪ একরের অতিরিক্ত জমি রাখিতে হইলেই সরকারি অনুমতি লইতে হইবে। ২৪ একরে ঠোঙা তৈরি বা বিড়ি বাঁধিবার ব্যবস্থা

বিলক্ষণ হইতে পারে; মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দের ‘শিল্প’, অর্থাত্‌ বিনোদনও চলিতে পারে। কিন্তু, যে শিল্পে অর্থনীতির চাকা ঘোরে, তাহার জন্য ২৪ একর অতি সামান্য। বৃহত্‌ শিল্পকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিলে বহু পূর্বেই এই একুশে আইনটিকে বিদায় করা বিধেয় ছিল। শিয়রে শমন উপস্থিত হইবার পরেও যখন সরকারের ততখানি সাহস হইল না, তখন শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গটিকে ধামাচাপা দেওয়াই ভাল।

বস্তুত, জমির ঊর্ধ্বসীমা বিলোপ করা প্রাথমিক কাজ মাত্র। শিল্পের জন্য যে জমি প্রয়োজন, যে কোনও ভাবে তাহার ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব। বিনিয়োগকারী সংস্থা বাজার হইতে জমি কিনিয়া লইবে, ইহাই সর্বোত্তম পরিস্থিতি। কিন্তু, সেই বিনিময়ের কাজটি যাহাতে বাধাহীন ভাবে হয়, সরকারকে তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে। জমির মালিক, জমির উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী এবং শিল্পসংস্থার মধ্যে সরকার মধ্যস্থতার কাজ করিবে। কাজটি কেবল শিল্পের স্বার্থেই নহে, জনস্বার্থেও জরুরি। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের জমির বাজারের চেহারা যে রূপ, তাহাতে শিল্পের জমি জোগাড়ের কাজটি শুধুমাত্র বাজারের মাধ্যমে হইবার সম্ভাবনা কম। কোনও ক্ষেত্রে প্রয়োজন হইলে সরকারকে জমি অধিগ্রহণ করিয়া দিতে হইবে। তাহার জন্য প্রত্যেকের সম্মতির অপেক্ষায় বসিয়া থাকিলে চলিবে না। পশ্চিমবঙ্গকে বাঁচাইতে হইলে বৃহত্‌ শিল্প জরুরি। তাহার পথে কোনও বাধা গ্রাহ্য না করাই বিধেয়। কিন্তু, এই কথাগুলি রাজ্যের শাসকদের নিকট অলীক ঠেকিবে। তাঁহারা সরকারি প্রকল্পের ক্ষেত্রেই জমি অধিগ্রহণে নারাজ, ফলে বেসরকারি বিনিয়োগের প্রশ্ন না তোলাই ভাল। সংকীর্ণ ভোটের রাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গের সর্বনাশ হইলেও তাঁহাদের যোগনিদ্রা ভাঙিবে না বলিয়াই আশঙ্কা। ভূমি সংস্কার আইনের সংশোধনীর ন্যায় হাসির খোরাক সম্ভবত ভবিষ্যতে আরও জুটিবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anandabazar editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE