Advertisement
০৬ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ২

ঠিক ভাবে জোট হয়নি, এটাও সত্য

শুধু সাংবাদিক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে আর দলীয় বিবৃতি দিয়ে জোটকে দৃঢ় করা যায় না। আমাদের হ্রস্বদৃষ্টি নেতাদের এ সবের জন্য অনেক আগে থেকেই উদ্যোগ করা উচিত ছিল। রা জ্য বিধানসভা নির্বাচনের রায় অনেককেই, এমনকী তৃণমূল কংগ্রেসের অনেক নেতাকেও হতবাক করে দিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই, এ নিয়ে দেশ জুড়ে চর্চা চলছে। এই চর্চায়, সারদা-নারদ-উড়ালপুল সত্ত্বেও, তৃণমূল কংগ্রেসের এই বিপুল জয়ের ব্যাখ্যা হিসেবে অনেকগুলো কারণ উঠে এসেছে।

অসীম চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

রা জ্য বিধানসভা নির্বাচনের রায় অনেককেই, এমনকী তৃণমূল কংগ্রেসের অনেক নেতাকেও হতবাক করে দিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই, এ নিয়ে দেশ জুড়ে চর্চা চলছে। এই চর্চায়, সারদা-নারদ-উড়ালপুল সত্ত্বেও, তৃণমূল কংগ্রেসের এই বিপুল জয়ের ব্যাখ্যা হিসেবে অনেকগুলো কারণ উঠে এসেছে।

এক, এ-যাবৎ ‘ডোল পলিটিক্স’ বা অনুদানের রাজনীতি, দেশের অন্য অঞ্চলে, বিশেষত তামিলনাড়ুতে, জনমানসে ছাপ ফেললেও, এই রাজ্যে কখনও তেমন নির্ণায়ক হয়ে ওঠেনি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এখন এই রাজনীতিই মানুষজনের ভাবনা পালটে দিতে পেরেছে। এখন অনেকেরই, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকার, ভাবনা হল, যদি দু’টাকা কিলো দরে চাল-গম পাওয়া যায়, যদি সরকার থেকে সাইকেল-জুতো পাওয়া যায়, কন্যাশ্রীর টাকা বা স্থানীয় ভাবে অনুদান পাওয়া যায়, তার ওপর যদি গ্রামের রাস্তাঘাট ঠিকঠাক থাকে, তবে সারদায় কার টাকা মারা গেছে, কোন নেতা টাকা নিয়েছে, কার দোষে উড়ালপুল ভেঙে মানুষ মারা পড়েছে, সে-সব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। বাম আমলে নেতারা তুলনায় সৎ হলেও এ সব তো পাওয়া যায়নি। এই জমানায় সরকার থেকে সরাসরি এই সব সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে এবং পরেও পাওয়া যাবে। অতএব সমর্থন। সন্দেহ নেই, অনুদান রাজনীতি রাজ্যে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, মমতাদেবীর এক বিপুল সমর্থন-ভিত্তি গড়ে তুলেছে, যা তাঁর বিপুল জয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছে।

দুই, তৃণমূল কংগ্রেসের এই জয়ে বিজেপির একটা বড় ভূমিকা আছে। মোদী-মমতা সমঝোতা হোক আর না-ই হোক, বিজেপির ভোট যে তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে লাভদায়ক হয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রত্যাশিত ছিল যে লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় বিজেপি যত ভোট কম পাবে, শাসক-বিরোধী ভোট হিসেবে সেটা প্রধানত বিরোধীদের কাছে যাবে। কিন্তু ঘটনা হল, কট্টর বাম-বিরোধী এবং কংগ্রেস-বিরোধী এই ভোট টিএমসির ঘরে এসেছে। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, বিজেপি ১০ শতাংশ ভোট পাওয়ায় বহু আসনে ত্রিমুখী লড়াই অনিবার্য হয় এবং এবং সেটা অন্তত একশোটি আসনে টিএমসির জয়ে সহায়ক হয়। বস্তুত, আমার নিজেরই ধারণা ছিল যে, টিএমসি ১২০টির বেশি আসন পাবে না, কিন্তু প্রধানত এই ত্রিমুখী লড়াইয়ের কারণেই সেই হিসেব মেলেনি।

তিন, এ সবের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক দেখা দিয়েছে বাম-কংগ্রেস জোটের প্রশ্নে। টিএমসির সাফল্য এবং বাম-কংগ্রেসের ভরাডুবির জন্য কংগ্রেস ও বামপন্থীদের জোট গঠনকেই অনেকে দায়ী করছেন। আমার কথা হল, জোট গঠন করার জন্য নয়, বরং ঠিক ভাবে জোট গঠন না করার ফলেই বিরোধীদের মূল্য দিতে হয়েছে। কংগ্রেস ও বামপন্থীদের মধ্যে আসলে জোট হয়নি, বিলম্বিত আসন-রফা হয়েছে, একেবারে শেষ লগ্নে। ফলে এই আসনরফার ঔচিত্য, প্রয়োজনীয়তা ও কার্যকারিতা নিয়ে বার্তা দলের নীচের মহলে প্রসারিত হয়নি, অতীত থেকে সঞ্চিত ক্ষোভ নিরসনের সুযোগ মেলেনি। ফল হয়েছে এটাই যে, এক দিকে যেমন ব্যাপক মানুষজনের কাছে জোটের নামে আসনরফার আবেদন থাকেনি, তেমনই একের ভোট অন্যের বাক্সে পড়েনি। বাম দলগুলি রেজিমেন্টেড হওয়ার কারণ দলীয় নির্দেশ মেনে বাম ভোট তাও কংগ্রেসের ঘরে গিয়েছে, কিন্তু কংগ্রেস ভোট, বিশেষত বাম আমলে নিগৃহীত কংগ্রেসকর্মীর ভোট বামেদের ঘরে আসেনি।

তবে এখানেও কথা আছে। কংগ্রেসের ভোটের সিংহভাগই মালদা-মুর্শিদাবাদে, সেখানে কংগ্রেসই প্রার্থী হয়েছে, সুতরাং ভোট স্থানান্তরের প্রশ্ন ওঠেনি। অন্যত্র হীনবল কংগ্রেসের ভোট তুলনায় কম প্রাসঙ্গিক ছিল। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, নিছক আসনরফার বদলে কেন্দ্রে বিজেপির সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ও রাজ্যে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সমস্ত বাম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির যথার্থ জোট হলে তা অনেক বেশি কার্যকর হত। জোটের যৌথ বিবৃতি, যৌথ কর্মসূচি, যৌথ জনসভা, সব স্তরের নেতা-কর্মীদের উদ্যোগকে উন্মোচিত করতে পারত এবং যৌথ আন্দোলনে জোটের ঐক্য পাকাপোক্ত হত। শুধু সাংবাদিক সম্মেলনে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে আর দলীয় বিবৃতি দিয়ে জোটকে দৃঢ় করা যায় না। আমাদের হ্রস্বদৃষ্টি নেতাদের এ সবের জন্য অনেক আগে থেকেই উদ্যোগ করা উচিত ছিল।

ভিন্নধর্মী দলের জোটগঠনে দলীয় আদর্শের সঙ্গে সমঝোতা অনিবার্য হয়— জোটকে আক্রমণ করে এই বক্তব্য এখন সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, মমতাদেবী স্বয়ং মুখ খুলেছেন। এই বক্তব্য অযৌক্তিক, অনৈতিহাসিক। ইতিহাস বলে, দেশে দেশে যুগে যুগে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ভিন্নধর্মী দলের জোটবদ্ধতা অনিবার্য হয়েছে। এ ভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের হাত থেকে মানবসভ্যতা রক্ষা পেয়েছে, চিনের স্বাধীনতা বজায় থেকেছে, এমনকী আমাদের দেশের গণতন্ত্র রক্ষা করা গিয়েছে। দলীয় স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখেই যুক্তমোর্চার অস্ত্রটি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে হবে, একে বর্জনের কথাই ওঠে না।

অনেকে আবার আসনরফার ফলে কংগ্রেসের শক্তিবৃদ্ধি ও বামেদের শক্তিহ্রাসের কথা তুলেছেন। এ কথা ঠিক যে, ২০১১ সালে বামফ্রন্ট ২৯ শতাংশ ভোট পেলেও এ বার ২৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে। কিন্তু যেখানে বামফ্রন্ট ২৯৪টি আসনেই প্রার্থী দেয়, সেখানে এ বারে ২০০টি আসনে প্রার্থী দেওয়ায় এই হ্রাস স্বাভাবিক। বরং দেখা সংগত যে, ২০১৪ সালে কংগ্রেস ও বামের প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ এ বারেও জোটের হাতে ধরে রাখা গিয়েছে। এ কথা ঠিক যে কংগ্রেসের ৪৪ আসনের পাশে বামফ্রন্ট পেয়েছে ৩৩টি। কিন্তু সংকীর্ণ দলীয় বিচার বাদ দিয়ে এ ক্ষেত্রে জোটের দৃষ্টিভঙ্গিই গ্রহণ করা উচিত।

এই অবস্থায় আওয়াজ তোলা হচ্ছে, ভোট শেষ তো জোট শেষ! এ এক আত্মঘাতী তত্ত্ব। ঘটনা হল, সারদা-নারদা-উড়ালপুল সত্ত্বেও এই বিপুল জয় স্বৈরাচারী নেত্রীকে আরও স্বৈরাচারী করবে। তার প্রতিরোধের জন্য এই জোট আরও বেশি করে জরুরি। তার ওপর ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে শুধু বাম-ঐক্য দিয়ে সর্বভারতীয় অঙ্গনে বিজেপিকে প্রতিহত করা যাবে না। তাই জোটকে আরও শক্তপোক্ত করে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলাই সমীচীন হবে।

আসলে এই সব বক্তব্য আসছে গভীর হতাশা থেকে। এ ক্ষেত্রে উচিত হবে এই নির্বাচনের রাজনৈতিক তাৎপর্য বোঝা। প্রসঙ্গত, আমার মনে পড়ছে ২০০৬ সালের নির্বাচনের কথা। গণতান্ত্রিক বাম বিকল্প গঠনের তাগিদে রেজিমেন্টেড পার্টিকে ক্ষমতা থকে হটানোর জন্য আমাদের দল সিএলআরআই মমতাদেবীর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে শামিল হয়। সেই নির্বাচনে আসনের হিসেবে ফল ছিল বামফ্রন্ট ২৩৫, তৃণমূল কংগ্রেস ৩০, কংগ্রেস ২০। এর ভিত্তিতেই তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর সেই অমর উক্তি: ‘আমরা ২৩৫, ওরা ৩০, আমাদের হটাবে কে?’ নির্বাচন শেষে মমতা জয়ী ও পরাজিত প্রার্থীদের নিয়ে এক সভা ডাকেন। সেই সভায় গভীর হতাশা। একের পর এক ভক্ত উঠে সেই হতাশা ব্যক্ত করছেন। মমতা আমাকে বলতে অনুরোধ করেন। বক্তব্যে আমি বলি যে, এই নির্বাচনের রাজনৈতিক তাৎপর্য বুঝুন। আসনসংখ্যার বিচারে হতাশা স্বাভাবিক। কিন্তু ভোটসংখ্যার বিচারে বামফ্রন্ট কিঞ্চিদধিক ৫০ শতাংশ, তৃণমূল কংগ্রেস আর কংগ্রেস মিলে বিরোধীরা ৪৯ শতাংশ। প্রায় সমান। তাই এই নির্বাচনী ফলের তাৎপর্য হল, বিধানসভায় সংগ্রামের গুরুত্ব হ্রাস পাবে, রাস্তার লড়াইয়ের গুরুত্ব বাড়বে। তখন আমরা বলদর্পী জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে ভাঙ্গড়, সিঙ্গুর যেতে আরম্ভ করেছি। তাই আমার বক্তব্য ছিল, এই জমির সংগ্রামে রাস্তায় নামুন। জমি বামফ্রন্টকে জমি দিয়েছে, জমির প্রশ্নই বামদের পায়ের তলা থেকে জমি কেড়ে নেবে। আমার এই বক্তব্যের পরেই মমতাদেবী আমাকে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন যা সবিনয়ে আমি প্রত্যাখ্যান করি। কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ। এখানে প্রাসঙ্গিক বক্তব্য হল, আসনের বিচারে তৃণমূল ২১১, বিরোধীরা ৭৭, কিন্তু ভোটসংখ্যার বিচারে তৃণমূল পেয়েছে ২ কোটি ৪৫ লক্ষ ভোট আর জোট পেয়েছে ২ কোটি ১৫ লক্ষ ভোট। ফারাক মাত্র ৩০ লাখের। তাই এই নির্বাচনী রায়ের রাজনৈতির তাৎপর্য হল, বিধানসভার সংগ্রাম গুরুত্ব হারিয়েছে, রাস্তার সংগ্রাম নির্ণায়ক হয়ে উঠেছে। বামপন্থা, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার স্বার্থে অবিলম্বে রাস্তার এই সংগ্রামে নেমে পড়তে হবে। এখনই।

প্রাসঙ্গিক বিষয় হাতের সামনেই রয়েছে। ভোট দেওয়া কোনও অপরাধ নয়, কোনও দলের এজেন্ট হওয়া অপরাধ নয়। অথচ এই জন্যই নির্বাচনোত্তর রাজ্যে সর্বত্র সন্ত্রাস চলছে। নির্বাচন কমিশন তাড়াতাড়ি গুটিয়ে চলে গিয়েছে। তাই রাজ্যপালের দ্বারস্থ হওয়া উচিত। এই কর্মসূচিকে শুধু সাংবাদিক সম্মেলন, রাজ্যপালের সঙ্গে সাক্ষাৎ বা দলীয় বৃত্তে
আবদ্ধ না রেখে নাগরিক সমাজ সহ সকল বাম-গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সমাবেশ, মিছিল করে রাজভবনে যেতে হবে। দলীয় কর্মসূচি বা অন্যান্য কর্মসূচির সঙ্গে কোনও বিরোধ নেই, কিন্তু বোঝার কথা হল, ব্যাপকতম মানুষের জমায়েত
ছাড়া শুধু বিবৃতি, স্মারকলিপি ইত্যাদি হবে বন্ধ্যা আনুষ্ঠানিকতামাত্র। এখন রাস্তাই একমাত্র রাস্তা। এই সত্য আমাদের নেতারা যত শীঘ্র বোঝেন, ততই মঙ্গল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE