পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রনৈতিক বা রাজনৈতিক বলতে ঠিক কী বুঝব? পলিটিক্যাল বা রাজনৈতিক-এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে বলতে হবে, রাজনৈতিক অ্যাকশন বা উদ্দেশ্য এখানে বিভাজিত শত্রু ও মিত্রের মধ্যে। রাজনৈতিক বলতে শত্রু ও মিত্রের বিভাজনের কথাটি বলেছিলেন উনিশ শতকের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কার্ল শ্মিট তাঁর প্রসিদ্ধ দ্য কনসেপ্ট অব দ্য পলিটিক্যাল গ্রন্থে। তিনি বোধ হয় আমাদের পশ্চিমবঙ্গের কথা ভেবেই অত দিন আগে গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন।
শত্রু ও মিত্র কথা দু’টি এখানে আলঙ্কারিক অর্থে ব্যবহৃত হয় না, প্রতীকী অর্থেও নয়। এরা ব্যক্তিও নয় ও আমার শত্রু নয়, আমাদের শত্রু— এবং এই ভাবে বিচার করলে আমরা বুঝতে পারি শত্রু/মিত্র হল পাবলিক ক্যাটেগরি। রাজনৈতিক আঙিনায় শত্রু ও মিত্রের বাস্তবতা, সত্যতা বোঝা যাবে লড়াই, সংঘাত, জঙ্গ, যুদ্ধের সময়। তাই শত্রু ও মিত্রের সঙ্গে যেটা অপরিহার্য ভাবে যুক্ত সেটা হল দাঙ্গা, মারামারি, জঙ্গ। সত্যিকারের দাঙ্গাবাজিতে শত্রু ও মিত্রের আসল অর্থ প্রকাশ পায়।
এই হল পশ্চিমবঙ্গের মানবিক অস্তিত্বের মূল কথা— তুমি তোমার শত্রুকে প্রাণে মারার জন্য সব সময় তৈরি থাকবে। এটা তার রাজনৈতিক অস্তিত্বও বটে। হিংসা, তার চরম অর্থ হত্যা-সহ, এই ভাবে পশ্চিমবঙ্গে এক বিশিষ্ট অর্থ গ্রহণ করেছে এবং সেই হিংসাই এখানে রাজনৈতিক অস্তিত্বের মূলে। অর্থাৎ রাজনৈতিক বলতে এখানে বোঝা হয় শত্রু ও মিত্রের আলাদা দল তৈরি করে তাদের পরস্পরকে হত্যা করার জন্য প্রস্তুত রাখা। রাজনৈতিকের এই ধারণার মাধ্যমেই এই রাজ্যে গণতন্ত্রকে বুঝতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গে গত পঞ্চাশ বছরের রাজনীতির ভিত্তিমূলে আছে শত্রু-মিত্র বিভাজন। বিভাজনের দাঙ্গাবাজির রাজনীতিতে মানুষ বাস করছে এক অবক্ষয়িত সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের পরিবেশে। এখানে একমাত্র প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হল, তুমি কাকে হত্যা করতে প্রস্তুত আছো এবং কার জন্য মৃত্যুবরণ করতে তৈরি আছো? এই বিষয়টি মানুষের জীবনেরও বিষয়, কারণ এখানে জীবনই হল ক্ষমতার সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু। জনগণের জন্য রাজনীতি তাই শেষ পর্যন্ত ত্রাস, আতঙ্ক, ভীতির রাজনীতি; মানুষ তাই ব্যস্ত থাকে সম্ভাব্য মৃত্যু, হয়রানি ও প্রতিবন্ধকতা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে। এই পত্রিকায় কিছু দিন আগে আমি পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের দলাদলির সর্বগ্রাসী প্রভাবের কথা লিখেছিলাম। দলাদলি শত্রু ও মিত্রের বিভাজনকে একটা নির্দিষ্ট চেহারা দেয়। খাড়াখাড়ি ভাবে শত্রু-মিত্র, আমরা-ওরা’য় বিভাজিত রাজনীতি তাই এখানে পরিচালিত হয়ে আসছে বৈষম্যমূলক, পক্ষপাতমূলক, অতএব হিংসা ও বিভেদের নীতির মাধ্যমে। এখানে ব্যক্তির বা নাগরিকের অস্তিত্ব সীমিত, খণ্ডিত। হত্যা, বিরোধ, সংঘাতের এই পরিবেশে নাগরিকদের পরস্পরনির্ভরতা সম্ভব নয়। শত্রু-মিত্রের রাজনীতি তা হতেও দেয় না। তাই আমরা বলতে পারি দলাদলি, শত্রু-মিত্র, হিংস্রতা পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রের এক ক্লোজার সৃষ্টি করেছে।
পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলি ও দলস্থ সমর্থকরা সমাজতাত্ত্বিক দিক থেকে এবং অস্তিত্বের দিক থেকেও নিজেদের কেবল শত্রু-মিত্রের বিভাজনের মাধ্যমেই দেখেন না, তাঁরা মনে করেন তাঁদের যদি এই পার্থক্য করার ক্ষমতা না থাকে তা হলে তাঁদের রাজনৈতিক অস্তিত্বও বিপন্ন হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ন্যায্যতা তাই রাজনৈতিক আদর্শের লড়াইয়ের মাধ্যমে প্রতিপন্ন হয় না, প্রমাণ হয় সত্যিকারের শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। শত্রু-মিত্র বিভাজনের অন্তর্নিহিত এই প্রবণতা রাজনৈতিককে এক হিংস্র সংঘর্ষ ও বিরোধে রূপান্তরিত করেছে। আলোচনা, সমঝোতা বা আবেদন এখানে বিরোধ মিটমাটে সক্ষম হয় না।
গত পঞ্চাশ বছর ধরে এই ট্র্যাডিশন সমানে চলে আসছে আমাদের রাজ্যে। হত্যা, হুমকি, ভয় প্রদর্শন, সন্ত্রাস সব সময়ই বঙ্গীয় শাসক দলের কাছে এক কার্যকর ও শক্তিশালী অস্ত্র। এর অর্থ, গণতান্ত্রিক কাঠামোর মাধ্যমে এমন এক শাসনের প্রবর্তন, যেখানে রাজ্যের নাগরিকদের কোনও শাস্তির ভয় ছাড়া হত্যা করা যায়, পঙ্গু করে দেওয়া যায়। রাজনীতি এখানে মানুষের জীবনকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে, মানুষের অস্তিত্ব ক্ষমতার সম্পর্কের লক্ষিত বস্তু হয়ে উঠেছে। এ যেন জিয়র্জিয়ো আগামবেন বর্ণিত ‘নগ্ন জীবন’-এর কথা। শত্রু-মিত্রের বিভাজন রাজ্যে কোনও রকম নাগরিক সমাজের উদ্ভব সম্পূর্ণ ভাবে আটকে দিয়েছে, কারণ, যেমন শ্মিট বলেছেন, এক জন প্রাইভেট মানুষ যার কোনও শত্রুতা নেই, তার অবস্থান রাজনৈতিক কমিউনিটির বাইরে। যে হেতু ‘আমরা-ওরা’র পক্ষপাতমূলক রাজনীতি এই রাজ্যের মানুষ দ্বারা স্বীকৃত একমাত্র রাজনৈতিক কার্যকলাপ, তাই সরকারের কাঠামোর বাইরে অবস্থিত নাগরিক সমাজের ধারণা এখানে সম্পূর্ণ ভাবে অনুপস্থিত।
শত্রু-মিত্রের পার্থক্য ও বিভাজন এক অপরিসীম হিংসা ও হিংস্রতার সম্ভাবনা তৈরি করে। বিরোধ ও হিংসার সম্ভাবনাই পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক অস্তিত্বের কাঠামো সৃষ্টি করবে। শ্মিট বলেছিলেন শত্রু-মিত্রের পার্থক্য অস্তিত্বমূলক ভাবে মারাত্মক, এবং এই মারাত্মক সমস্যাই প্রকাশ পায় হিংস্র বিরোধের মাধ্যমে। শত্রু-মিত্রের পার্থক্যকে অন্য কোনও পার্থক্য বা ভিন্নতায় পর্যবসিত করা যায় না। ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, জাতিভিত্তিক পার্থক্য তখনই রাজনৈতিক পার্থক্যের রূপ ধারণ করবে, যখন তারা শত্রু-মিত্রের ভেদ উৎপন্ন করবে— এই হল আজকের পশ্চিমবঙ্গের বিশ্বাস। সুতরাং এটা কোনও আশ্চর্যের বিষয় নয় যে পশ্চিমবঙ্গ আজকের ভারতের সবচেয়ে হিংস্র রাজ্য।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি উদারনৈতিক মতবাদের ব্যর্থতা প্রতিপন্ন করে। উদারনীতি শত্রু-মিত্রের পার্থক্যকে মতের পার্থক্য বা অর্থনৈতিক পার্থক্য হিসেবে বুঝতে চায়। উদারনৈতিক ইউটোপিয়া দাবি করে যে, সমস্ত বিরোধ যুক্তি ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে শত্রুর সঙ্গে কোনও মিত্রতা চলবে না। বর্তমান শাসক দলের নেত্রী যখন বিরোধী দলনেত্রী ছিলেন, তখন তিনি এক দিনের জন্যও শাসক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসেননি। প্রয়োজনে শত্রুকে শেষ করে দিতে হবে, যদি তার সুযোগ অবিলম্বে না আসে, দলস্থ মানুষকে সর্বদা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে: ‘ওই দেখো আমাদের শত্রু’। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির বাস্তববাদী মূল্যায়ন বলে, পার্থক্য মুছতে পারে শুধু হিংসার মাধ্যমে। অক্ষম বিচারব্যবস্থা, আজ্ঞাবহ আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ও অনুপস্থিত নাগরিক সমাজ তাই এখানে সৃষ্টি করেছে এমন এক লুম্পেনরাজ, যারা কোনও রকম আইনকানুনের তোয়াক্কা করে না।
শত্রু-মিত্রের রাজনীতির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, বিবদমান গোষ্ঠীর কোনও পক্ষেরই কোনও নৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকে না। এই রাজনীতির একমাত্র নৈতিকতা হল, শত্রুকে সূচ্যগ্র জমি ছাড়লে চলবে না। তাকে শেষ করে দিতে পারলে সবচেয়ে ভাল। শত্রুর হত্যাই হল সবচেয়ে বড় নৈতিক কাজ। সেই জন্যই আজ আবার পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে দেখছি প্রতিটি আসন বিরোধীশূন্য করার প্রাণপণ প্রচেষ্টা। প্রয়োজনে শত্রুপক্ষের মনোনীত প্রার্থীকে, নারী বা বৃদ্ধ হলেও, পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দাও। দরকারে অদরকারে ভয় দেখিয়ে গুলি করে মেরে ফেলো। এই হল সত্যিকারের নৈতিক জয়। তোমার শত্রুকে তুমি এক ইঞ্চি জমি ছেড়ে দাওনি। বাম আমলে ঠিক একই কাণ্ড ঘটেছে। এর জন্য বামেরা কোনও অনুতাপ প্রকাশ করেছে এমন কোনও দিন শুনিনি। এ যেন পুরনো ছবি আরও এক বার দেখছি। সময় যায়, দল বদলায়, রাজনীতির স্টাইলে কোনও পরিবর্তন হয় না।
স্বীকার করে নিতেই হবে, এই হল এ রাজ্যের রাজনৈতিক পরম্পরা। মুষ্টিমেয় রাজনীতিবিদ শয়তানি করছেন এবং মানুষ এটা চান না— এই স্তোকবাক্যে চিঁড়ে ভিজবে না। মানুষ যদি না-ই চান, তা হলে এই পরম্পরা পঞ্চাশ বছর ধরে চলছে কেন? একটি উত্তর হতে পারে, মানুষ ক্ষমতাহীন, দমনপীড়নে ভীত। তাঁরা উদ্ভিদতুল্য। কিন্তু আমার উত্তর তা নয়। কারণ, ক্ষমতা এই ভাবে কাজ করে না। আমার উত্তর হল, সর্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী দলাদলির জমানায় এ রাজ্যের মানুষও দলস্থ মানুষ। তাঁর দলের ভাগ্যের সঙ্গে তাঁর ভাগ্য যুক্ত। এঁদের মধ্যে অবশ্য দলবদলকারী চতুরেরা আছেন। কিন্তু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সকলেই এই শত্রু-মিত্র ও মারদাঙ্গার রাজনীতির সমর্থক। এই রাজনীতি শুধু হিংসাই সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু সব সময় হিংসার স্ট্র্যাটেজি যে সফল হবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। ফলে সবচেয়ে সম্ভাব্য পরিণতি হল— আরও বেশি হিংসা। হিংসা ফল দেয়, কিন্তু ফল দেয় অনির্দিষ্ট ভাবে। এটাই পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক।
মুক্তির উপায় কিছু আছে? আমার মনে হয় নেই। আমি মনে করি সমাজ-রাজনীতিতে বিশিষ্ট জনদের কোনও ভূমিকা নেই, তাই তাঁদের কথা তুলব না। আমি দোষ দেব এই রাজ্যের মানুষের অপদার্থতা, ভীরুতা ও মেরুদণ্ডহীনতকে। নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করার কোনও সাহসই তাঁরা অর্জন করতে পারেননি। বঙ্কিমচন্দ্র এক বার বলেছিলেন, ‘‘বাঙ্গালী শুধু কান্দে আর উৎসন্নে যায়।’’ আজও অবস্থা ঠিক তা-ই। আলো ক্রমশ নিভে আসছে।
সমাজবিজ্ঞানী, সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ ভূতপূর্ব শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy