Advertisement
১৭ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

প্রতিদান

চার দশক ধরে গ্রামে গ্রামে মা ও বাচ্চার স্বাস্থ্য আর পুষ্টির দায়িত্ব সামলাচ্ছেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা। অথচ তাঁরাই সম্পূর্ণ অবহেলিত। ঝা ড়গ্রাম শহর থেকে দশ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকলে, এসে পড়বে জমিদারডাঙা। আদিবাসী অধ্যুষিত ছোট্ট গ্রাম। সকাল আটটার সূর্য, শাল আর বাঁশের ঘেরাটোপ পেরিয়ে এসে পড়ছে মাস কয়েক আগে গড়ে ওঠা দশ ফুট বাই দশ ফুট পাকা বাড়িটার উঠোনে। ভেতরে জনা পঁচিশেক বাচ্চাকে হাত ধরে ধরে স্লেটে স্বরবর্ণ চেনাচ্ছেন পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই এক ভদ্রমহিলা।

অনীক চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৬ ০০:১৫
Share: Save:

ঝা ড়গ্রাম শহর থেকে দশ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকলে, এসে পড়বে জমিদারডাঙা। আদিবাসী অধ্যুষিত ছোট্ট গ্রাম। সকাল আটটার সূর্য, শাল আর বাঁশের ঘেরাটোপ পেরিয়ে এসে পড়ছে মাস কয়েক আগে গড়ে ওঠা দশ ফুট বাই দশ ফুট পাকা বাড়িটার উঠোনে। ভেতরে জনা পঁচিশেক বাচ্চাকে হাত ধরে ধরে স্লেটে স্বরবর্ণ চেনাচ্ছেন পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই এক ভদ্রমহিলা। পাশেই হাঁড়ি চড়েছে— খিচুড়ি, ডিম। একটু পরেই গ্রামের সমস্ত প্রসূতি এসে ভিড় করবে উঠোনে। ভদ্রমহিলা তাদের খাবার দিতে দিতে কাউকে স্নেহের সুরে বকবেন, ‘এই বাচ্চাটা যদি হাসপাতালে না হয়েছে তা হলে কিন্তু তোমার কপালে দুঃখ আছে ছিতামণির মা।’ কাউকে বলবেন, ‘ছ’মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ খাওয়াও বাচ্চাকে, বুঝলে?’ ফেরার পথে এক বাড়ি থেকে ডাক পড়ে, ‘দিদিমণি কুলেখাড়া শাক নিয়ে যান।’ দিদিমণি শাক নেন, সবার কুশলসংবাদ নেন, উদরাময় হয়েছে যে বাচ্চাটার তাকে নুন-চিনির জল খাওয়াতে বলেন বারে বারে। আর বলেন, কিছু বিপদ বুঝলেই সঙ্গে সঙ্গে যেন ঝাড়গ্রাম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পর সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেন। বাড়ি ফিরে সমস্ত সংসারের কাজ করতে হবে একা হাতে।

ভদ্রমহিলা এ দেশের আটাশ লক্ষ অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী-সহায়িকার এক জন। ১৯৭৫-এ শুরু হওয়া ‘সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্প’-এর জোয়াল যাদের কাঁধে চাপিয়ে সরকার হাত ঝেড়ে ফেলেছে বিভিন্ন সময়। এখন ছ’বছরের কম প্রায় আট কোটি শিশু ও প্রায় দু’কোটি প্রসূতি এই প্রকল্পের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের ছোঁয়াটুকু পান। এ দেশের গর্ভে ঢুকে আছে যে লক্ষ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত গ্রাম, যেখানে অর্থনৈতিক উন্নতির আলো ‘ট্রিকল ডাউন থিয়োরি’ মেনে পৌঁছতে পেরিয়ে যায় বছর, দশক, সেখানে ভবিষ্যতের ভ্রূণগুলির কাছে বাঁচার অক্সিজেন পৌঁছে যায় এই কর্মীদেরই হাত ধরে। গর্ভবতীদের নাম নথিভুক্তকরণ, গর্ভকালীন বিপদচিহ্নগুলিকে সময়মত চিহ্নিত করা, হাসপাতালে প্রসব করানোর সচেতনতা গড়ে তোলা, মা ও শিশুর টিকাকরণ এবং তাদের দৈনিক সুষম খাবার পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা বয়ে চলেছেন গত চার দশক। (পরবর্তী কালে আশা কর্মীরা গর্ভবতীেদর পরিষেবা দেওয়ার জন্য নিযুক্ত হলেও বেশির ভাগ জায়গায় অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরাই এই দায়িত্ব পালন করেন)। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক কালে পোলিও নির্মূল যজ্ঞের প্রধান হোতাও এই কর্মীরা। অতীতে গোদ বা কুষ্ঠের মতো রোগগুলিকে নিশ্চিহ্ন করার সরকারি উদ্যোগেও শ্রম ঢেলেছেন তাঁরাই।

শ্রম করে চলেছেন আজ পঁচিশ বছর, তবু সেই বছর পঞ্চাশের ভদ্রমহিলা বোঝেন না কেন তিনি সরকারি ভাবে শ্রমিক নন, শুধুই স্বেচ্ছাসেবী। তাঁকে প্রতিটা দিন যে শুধু অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে গিয়ে শিশু ও মায়েদের সুষম খাবার আর শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাটুকু দিতে হয় তাই-ই নয়, সামলাতে হয় তাঁর কেন্দ্রের মানুষদের নানা দাবিদাওয়ার চাপ, স্থানীয় রাজনৈতিক চাপ, বাড়ি ফিরে সংসার সামলে বসতে হয় গোটা দশেক খাতা নিয়ে যেখানে নথিভুক্ত করতে হয় মা ও শিশুর ওজন, শিশুর বৃদ্ধির হিসেব, প্রতি দিনের চাল-ডাল-নুন-তেল-ডিমের হিসেব। মাসের শেষে সমস্ত খতিয়ান দিতে হয় মুখ্যসেবিকাকে।

এর পরেও তিনি শুধুই স্বেচ্ছাসেবী, মাস গেলে সাম্মানিক হিসেবে পান ৪৪০০ টাকা। আর তাঁর সহায়িকা ২৮০০ টাকা। ’৯১ সালে যখন কর্মী হিসেবে যোগ দেন তখন মাস গেলে হাতে পেতেন ২৭৫ টাকা। ২০১১’তে শেষ বার সাম্মানিক বেড়েছে। এই টাকা দিয়েই সংসার টেনেছেন, ছেলেমেয়েকে পড়িয়েছেন, একটা দুটো করে শখের জিনিস করেছেন। এ রাজ্যে দেড় লক্ষ কর্মী ও সহায়িকা আছেন যাঁদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে এই ক’টা টাকার ওপর। আজ পঁচিশ বছর শ্রম দিয়েও সেই ভদ্রমহিলা জানেন অবসরের সময় নেই কোনও সরকারি বা সামাজিক সুরক্ষার আশ্বাস।

এঁরা সরকারি শ্রমিকের মর্যাদা পাননি, তার কারণ নিজেদের অধিকার বিষয়ে সচেতন হতে পারেননি। বিগত চল্লিশ বছরে গর্ভকালীন মৃত্যু বা শিশুমৃত্যুর হার কমানোর জন্য সরকারি হাসপাতাল ও তার ডাক্তার-নার্সরা যতটা গুরুত্ব পেয়ে থাকেন, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী-সহায়িকারা তার চেয়ে কিছু কম পাওয়ার যোগ্য নন। অপুষ্টি, রক্তাল্পতা ইত্যাদি দৈত্যগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সেনানীরা ক্ষতবিক্ষত হয়েও আজও অবহেলিত। দিনের পর দিন নিজেদের শ্রম, সময় নিয়োজিত করেও শিক্ষা ও রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবেই সংগঠিত হয়ে নিজেদের দাবি বুঝে নিতে পারেননি। ফলে স্বাস্থ্যের যে সূচকগুলি বিশ্বের দরবারে দেখিয়ে সরকার নিজের কলার তোলে আজ, সেগুলি বাস্তবায়িত করেন যাঁরা, তাঁদের দিন কাটে বঞ্চনায়।

২০১৩’য় কংগ্রেস সরকার প্রকল্পটিকে ‘মিশন’ ঘোষণা করে বিভিন্ন এনজিও আর কর্পোরেটের ‘চ্যারিটি’র হাতে তুলে দেওয়ার পথ খুলে দেয়। তার পর কেন্দ্রে ‘আচ্ছে দিন’-এর সরকার এসে ’১৪-১৫তে বরাদ্দ বাজেটের থেকে ’১৫-১৬তে এক ধাক্কায় অর্ধেকের নীচে নামিয়ে দেয়! বিভিন্ন রাজ্যে পাঁচ-ছয় মাস কোনও সাম্মানিক পাননি এই কর্মী-সহায়িকারা। মুখ থুবড়ে পড়ে টিকাকরণ বা সুষম খাবার দেওয়ার প্রকল্পগুলি। তার আঁচ সামলাতে হয় অসহায় কর্মী-সহায়িকাদেরই। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার ‘বেদান্ত’র হাতে তুলে দিয়েছে চার হাজার অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। সঙ্গে নতুন উদ্যোগ, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের নাম বদলে রাখা হবে ‘নন্দঘর’— গৈরিকীকরণের নবতম সংযোজন! মিশন ঘোষণা, বাজেট বরাদ্দ ইত্যাদি একটি ক্ষেত্রেও সরকার ২৮ লক্ষ শ্রমশক্তি বিশিষ্ট এই ক্ষেত্রটির কোনও কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে মত বিনিময়ের প্রয়োজন মনে করেনি।

দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ মরিয়া হয়। ৬ অক্টোবর, ২০১৫ এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ প্রায় প্রতিটি রাজ্য থেকে সব মিলিয়ে লক্ষাধিক অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী-সহায়িকারা দিল্লির রাজপথে নেমেছেন, সংসদ অভিযান করেছেন। রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় স্তরে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন সম্মিলিত ভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে। মূলত সেই চাপেই কেন্দ্রীয় বাজেটে বরাদ্দ কিছুটা বাড়িয়ে ১৪০০০ কোটি টাকা করতে বাধ্য হয়েছে। তবে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকাদের যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেিণর সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা, ন্যূনতম বেতন ১৮০০০ টাকা এবং পিএফ, গ্র্যাচুইটি, পেনশন চালু করার দাবিগুলি আদায় করতে এখনও বাকি অনেকটা পথ।

ওই ভদ্রমহিলাটি এখন সেটা বোঝেন। আজ তিনি তাঁর কেন্দ্রের কাজ সামলে, সংসার সামলে, চোয়াল শক্ত করে ঝাড়গ্রাম অঞ্চলের কর্মী ও সহায়িকাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ছেন। আমি তাঁকে গত ছাব্বিশ বছর ধরে মা হিসেবে চিনতাম। আজ রাজনীতিসচেতন, নিজেদের অধিকারের দাবিতে এগিয়ে আসা এক জন মানুষ হিসেবে চিনছি। বুঝছি, ‘তোমাকে চাই’-এর ‘তুমি’টা মা-ও হতে পারে। পেলাগেয়া নিলোভনা আর পাভেলের সম্পর্ক অন্য রকম ভাবে চিনছি গোর্কির ‘মা’ লেখার এক শতক পরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE