Advertisement
১৮ মে ২০২৪
হাতেকলমে হিন্দুরাষ্ট্র
Delhi Violence

শেষ অবধি নেহরু-যুগের গণ্ডি টপকাতে পারল মোদী-শাহের ভারত

আজ না হোক পরশুর পরের দিন দিল্লি স্বাভাবিক হবে। খাঁচাগাড়িতে চেপে ঘর ছাড়া মুসলমানদের অনেকেই ফিরে আসবেন পুরনো ঠিকানায়।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

আজ না হোক পরশুর পরের দিন দিল্লি স্বাভাবিক হবে। খাঁচাগাড়িতে চেপে ঘর ছাড়া মুসলমানদের অনেকেই ফিরে আসবেন পুরনো ঠিকানায়। চোরা অস্বস্তি নিয়েই পুরনো চেহারায় ফিরবে শহর। সেই প্রাত্যহিকতায় প্রত্যাবর্তনে অবশ্য ঢাকা পড়বে না একটা কথা— ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পর্বান্তর ঘটেছে।

পর্বান্তর? একটা যুগ শেষ হয়ে অন্য যুগের সূচনা? একেবারেই। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এত দিনে অতিক্রম করতে পেরেছে নেহরু-যুগের গণ্ডি। নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসা ইস্তক এত বার নেহরু-যুগের মৃত্যুসংবাদ ঘোষিত হয়েছে যে আজকের পর্বান্তরকে নেহরু-যুগের গণ্ডি অতিক্রম করা বললে তাকে ‘পর্বান্তর’ হিসেবে দাবি করাই মুশকিল। তার পরও, এই পর্বান্তরকে নেহরু-যুগের পরিপ্রেক্ষিতে না দেখলে তার মূল চরিত্র ধরা যাবে না।

স্বাধীন ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির রেটরিককে দেখা যায় নেহরুর ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের সম্পূর্ণ বিরোধী অবস্থান হিসেবে। সেই হিন্দুত্ববাদের মূল সুরটা পাওয়া যাবে মাধব সদাশিব গোলওয়ালকরের লেখায়— ‘আমরা যখন বলি, ভারত একটি হিন্দুরাষ্ট্র, সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন ওঠে— ভারতের মুসলমান বা খ্রিস্টানদের তবে কী হবে? তারাও তো এই ভারতেই জন্মেছে। তবে কি এই দেশ তাদের নয়? প্রশ্ন হল, এই দেশ যে তাদেরও, সেটা আমরা মনে রেখে কী করব? কথাটা তো তাদের মনে রাখা উচিত।’ (মূল লেখাতেই জোর দেওয়া রয়েছে) আ বাঞ্চ অব থটস-এ এই কথার ঠিক পরেই গোলওয়ালকর লিখছেন, ‘যারা হিন্দু থেকে মুসলমান বা খ্রিস্টান হয়েছে, তাদের জন্ম এই দেশেই, নিঃসন্দেহে। কিন্তু... যে দেশ তাদের বড় করল, তারা কি সেই দেশের প্রতি কৃতজ্ঞ? তারা কি নিজেদের এই দেশের এবং তার সংস্কৃতির সন্তান বলে মনে করে? তারা কি দেশের জন্য কাজ করতে চায়? না! ধর্ম পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গেই তারা দেশের প্রতি আনুগত্য ও ভালবাসাও ত্যাগ করে।’ অর্থাৎ, নেহরু-যুগের ভারত যেখানে দেশের ধারণা থেকে ধর্মের ধারণাকে বিচ্ছিন্ন করছিল, জানাচ্ছিল যে দেশ যেমন একক ভাবে কোনও ধর্মের নয়, তেমনই কোনও ধর্মও একক ভাবে এই দেশের নয়— ঠিক সেই মুহূর্তেই নাগপুর ঘোষণা করছিল দেশের এক ভিন্নতর সংজ্ঞা। যে সংজ্ঞায় হিন্দুত্ব আর ভারত অবিচ্ছেদ্য— এবং, হিন্দুত্বের প্রতি বিশ্বস্ততা হল দেশের প্রতি বিশ্বস্ততার আবশ্যিক শর্ত।

সম্পূর্ণ প্রতিস্পর্ধী অবস্থান। কিন্তু, যে পরিসরে সেই অবস্থানটি নিচ্ছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, সেই পরিসরটি যে নেহরু-যুগের নৈতিকতার, সেটাকে স্বীকার করে নেয় এই অবস্থান। অর্থাৎ, সঙ্ঘ যেটা চাইছে, সেটা যে ভারতের সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসরে অবৈধ— সেই পরিসরের কাঠামো ভেঙে নতুন করে না গড়লে এই দাবি অর্জন করা যাবে না— এই উপলব্ধি দাবিটার মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজনৈতিক বয়ান তো এ ভাবেই এগোয়— প্রচলিত রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থাটাকে স্বীকার করে নিয়ে তার পর সেটাকে পাল্টানোর কথা বলে। ঠিক যেমন বামপন্থীরা সর্বহারার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার, বিপ্লবের কথা বলতেন— কে জানে, এখন আর বলেন কি না— গণতান্ত্রিক সংসদীয় রাজনীতির পরিসরটাকে স্বীকার করে নিয়ে। অর্থাৎ, ঘোষিত ভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন হয়েও আরএসএস যে অবস্থানটি নিয়েছিল, সেটা একেবারে প্রথাগত রাজনীতির।

তাদের রাজনীতির কার্যত প্রতিটি দাবিই প্রোথিত ছিল মুসলমান-বিদ্বেষে। ভারতীয় জন সঙ্ঘ থেকে বিজেপি, হিন্দুত্ববাদের সংসদীয় ধারাটি এই বিদ্বেষের উত্তরাধিকার বহন করেছে রাজনীতির ময়দানে। কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বিলোপই হোক, অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠাই হোক, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দাবিই হোক— বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহার ঠাসা থাকত যে সব দাবিতে, তার প্রতিটির মূল সুর বাঁধা এই তারে যে ভারতে যদি থাকতেই হয়, তবে মুসলমানদের থাকতে হবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে। মারাত্মক দাবি, কিন্তু সেই দাবিকেও ধরা যেত নেহরুবাদী ভারতের কাঠামোয়— আর কিছু না হোক, দাবিগুলোর অন্যায্যতা, অবৈধতা স্পষ্ট ভাবে দেখা যেত। হিন্দুত্ববাদীরা বাবরি মসজিদ ভেঙেছে ১৯৯২ সালে। কিন্তু, তার পর লালকৃষ্ণ আডবাণীকে কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন দিতে হয়েছিল, নিজের মনোবেদনার কথা জানাতে হয়েছিল সাংবাদিককুলকে। নচেৎ, দেশের মূলধারার রাজনীতিতে তাঁর বৈধতা থাকত না। ২০০২ সালের গুজরাত গণহত্যার পর অটলবিহারী বাজপেয়ীকে ‘রাজধর্ম’ ইত্যাদি আওড়াতে হয়েছিল। হিসেব ছিল পরিষ্কার— হিন্দুত্ববাদের কুঠার বইবেন উমা ভারতী বা নরেন্দ্র মোদীরা, আর দলের রাজনৈতিক বৈধতা বজায় রাখবেন আডবাণী-বাজপেয়ী। নেহরু-যুগের নৈতিকতাকে যদি তাঁরা রাজনৈতিক পরিসরে অস্বীকার করতে পারতেন, তা হলে নাটকগুলোর দরকার পড়ত না।

এমনকি, ২০১৪ থেকে ২০১৯ অবধি ভারত যে বিপজ্জনক পথে চলেছে, সেই ঘোরতিমিরঘন সময়টুকুর কথাও যদি ভাবি, দেখব, গোসন্ত্রাসের সঙ্গে একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছেন নরেন্দ্র মোদী। তিনি হিন্দুহৃদয়সম্রাট— মুসলমানদের একক-নিধনে তিনি আপত্তি করেননি ঠিকই, তাঁর ‘মন কি বাত’-এ কখনও আডবাণীসম নাটকটুকুও শোনা যায়নি, কিন্তু প্রকট ভাবে সমর্থনও করেননি এই নিধনযজ্ঞকে। মুসলমানরা ক্রমে বিপন্ন হয়েছেন, গুটিয়ে গিয়েছেন, কিন্তু রাষ্ট্রীয় পরিসর তখন অবধি সেই বিপন্নতাটুকুকে স্বীকার করত। গোরক্ষকেরা যে সন্ত্রাস করছে, সেটাকে যে রাষ্ট্র খাতায়কলমে বৈধতা দেয় না, এটুকু জায়গা অন্তত ছিল। খড়কুটো, তবুও।

পর্বান্তর ঘটল ২০১৯ সালের মাঝামাঝি। তত দিনে কেন্দ্রীয় সরকারের দু’নম্বর (না কি, এক নম্বরই?) মুখ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন অমিত শাহ। মোদী-শাহের যুগলবন্দি এক অর্থে বিজেপির ক্লাসিক কম্বিনেশন— ২০০২-এ মোদী যেমন ছিলেন ‘নরমপন্থী’ আডবাণীর চরমপন্থী পরিপূরক, ২০১৯ সালে ‘নরমপন্থী রাষ্ট্রনেতা’ নরেন্দ্র মোদীর পরিপূরক হিসেবে চরমপন্থী অমিত শাহ প্রতিষ্ঠিত হতেই পারেন। সেই চরমপন্থী নেতা ভাঙবেন তো বটেই— বস্তুত, ভাঙার জন্যই তো তাঁর গুরুত্ব— কিন্তু মোদী-শাহ যুগলবন্দি যা ভাঙতে আরম্ভ করলেন, তা অদৃষ্টপূর্ব। হিন্দুত্ববাদীরা বাবরি মসজিদ ভেঙেছিল— দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার তন্তুর ওপর তা গুরুতর আঘাত— কিন্তু, বাবরি মসজিদ দেশ ছিল না। অমিত শাহেরা দেশ ভাঙছেন। এবং, প্রতিষ্ঠা করছেন গোলওয়ালকরের স্বপ্নগুলোকে— এত দিন যা সীমাবদ্ধ ছিল হিন্দুত্ববাদী রেটরিকে। এখানেই পর্বান্তর। স্বাধীনতার পরের ৭২ বছরে হিন্দুত্ববাদীরা যা পারেনি, গত ছ’মাসে অমিত শাহেরা ঠিক সেটাই করছেন। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাবদ প্রাপ্ত সব সুবিধা মুছে গিয়েছে। সংসদে পাশ হয়েছে নয়া নাগরিকত্ব আইন। আদালত জানিয়েছে, মন্দির ওহি বনেগা। রাজনৈতিক রেটরিকে নয়, একেবারে সাংবিধানিক ভাবে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে জোরকদমে।

এত দিন যা শপথ ছিল, তার বাস্তবায়নের কাজ আরম্ভ হলে সেটা পর্বান্তর কেন? যে দিন কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত হল, সেই ৫ অগস্ট তারিখ থেকে মোদীরা যা যা করলেন, মুসলমান সমাজে তার প্রতিক্রিয়া তাৎপর্যপূর্ণ। শাহিন বাগের কথা মনে রেখেও বলতে হয়, এক অর্থে তাঁরা যেন স্বীকারই করে নিয়েছেন অবনাগরিক হয়ে থাকার ভবিতব্য। মোদীর পাঁচ বছরের শাসনও তাঁদের এই পরাজয় স্বীকার করাতে পারেনি, গত ছ’মাস যা পেরেছে।

দিল্লির এই হত্যালীলা আসলে আরও এক বার এই পরাভবের কথাই মনে করিয়ে দেওয়া। বুঝিয়ে দেওয়া, অবনাগরিকদের সঙ্গে যেমন খুশি আচরণের রাষ্ট্রীয় ছাড়পত্র হিন্দুত্ববাদীরা পেয়ে গিয়েছে। এই গণহত্যা স্বাভাবিক— যে কারণে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তিন দিন পরে টুইট করে শান্তিরক্ষার আবেদন জানাতে পারেন; তাঁর নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলতে পারেন, ‘যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে।’ ২০০২ সালে প্রধানমন্ত্রীকে ‘রাজধর্ম’ আওড়াতে হয়েছিল। আরও একটা ফারাক মনে রাখার মতো— ২০০২ সালে সদ্য মসনদে বসা নরেন্দ্র মোদীর সামনে বিধানসভা নির্বাচন ছিল। দিল্লি সদ্য নির্বাচন পেরিয়ে এসেছে। ভোটের যুক্তিতেও এই হত্যালীলাকে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। পড়ে থাকে একটাই বিকল্প— দিল্লির গণহত্যা শুধু এটুকু বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি তার নতুন অবতারে আবির্ভূত হয়েছে। মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে নেহরুর ভারত মৃত, এটা গোলওয়ালকরের ভারত।

আজ না হোক কাল দিল্লি শান্ত হবে। কিন্তু, মনে করিয়ে দেওয়ার পালা ফুরোবে না। আরও অনেক আগুন অপেক্ষা করছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE