Advertisement
০১ মে ২০২৪
Communal harmony

Communal Harmony: অপরিচয়ের বেড়া টপকাতে

কর্মক্ষেত্রেও কি হিন্দু-মুসলিম পরস্পর সহকর্মী হতে পেরেছে?

প্রসেনজিৎ সরখেল
শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২১ ০৪:৪৮
Share: Save:

যাঁরা মুসলমানদের প্রতি বিভেদ, বিদ্বেষকে সমর্থন করেন না, তাঁরাও কি মুসলমানদের সঙ্গে অপরিচয়ের দূরত্ব অতিক্রম করতে পেরেছেন? আমার স্কুলে তবু দু’এক জন মুসলমান সহপাঠী ছিল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউকে পাইনি। যে অঞ্চলে বাস করি, সেখানে মুসলিম নগণ্য। ইফতারে রাজনৈতিক নেতাদের যোগ দিতে দেখেছি, আমার এত দিনেও সুযোগ ঘটেনি। অপরিচয়ের গণ্ডি ভাঙবে কিসে?

ভারতে হিন্দু আর মুসলিমদের মধ্যে আদানপ্রদান কতটা, তা নিয়ে সম্প্রতি একটি সমীক্ষা করেছে আমেরিকার একটি গবেষণা সংস্থা। সেই সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে যে, ৫৬ শতাংশ হিন্দু প্রায়শই মুসলিমদের সঙ্গে মেলামেশা করেন বলে জানিয়েছেন। আর হিন্দুদের সঙ্গে নিয়মিত মেলামেশা করেন, এমন মুসলিমের সংখ্যা ৭০ শতাংশ। অর্থাৎ, দশ জন মুসলিমের তিন জন, আর দশ জন হিন্দুর অন্তত চার জন, অন্য ধর্মের মানুষের সঙ্গে তেমন মেশেন না।

তার একটা কারণ, আমাদের বাসস্থানগুলো পরস্পরের থেকে অনেকটা দূরত্বে। নানা শহরে মুসলমানদের বাসস্থান এখনও প্রধানত কয়েকটি বিশেষ অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। দিল্লির প্রায় ২০০০ আবাসনের তথ্য নিয়ে দেখা গিয়েছে যে, প্রায় ৭০ শতাংশ আবাসনে কোনও মুসলমান বাসিন্দা নেই, এবং ৯৬ শতাংশ আবাসনের ক্ষেত্রে মুসলমান পরিবারের সংখ্যা ১০ শতাংশের কম। কলকাতা শহরেও মুসলিমদের বাড়ি ভাড়া পেতে যথেষ্ট সমস্যায় পড়তে হয় বলে প্রায়শই খবরে দেখি।

কর্মক্ষেত্রেও কি হিন্দু-মুসলিম পরস্পর সহকর্মী হতে পেরেছে? অতীতে বর্ণাশ্রম প্রথা চালু ছিল। রাষ্ট্র যদি সব ছেলেমেয়েকে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধে সমান ভাবে দেয়, তা হলে পরবর্তী প্রজন্ম জাত-ধর্ম-শ্রেণির বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাবে, ছড়িয়ে যাবে সব রকম পেশায়। অধ্যাপক, চিকিৎসক, উকিলের মতো উচ্চ আয়ের পেশায় সব জাত-ধর্মের মানুষকে পাওয়া যাবে। তেমন কি ঘটছে? হিন্দুদের নিরিখে মুসলিমরা উচ্চশিক্ষায় বা উচ্চ আয়ের পেশায় কতটা পিছিয়ে, সাচার রিপোর্ট থেকে শুরু করে নানা সমীক্ষা, গবেষণা, বার বার তা স্পষ্ট করেছে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা (২০১২) বলছে যে, শহরাঞ্চলে স্বনিয়োজিত পেশা এবং ঠিকা শ্রমিকদের অধিকাংশই মুসলমান। অর্থাৎ, হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে আদানপ্রদান যদি ঘটেও, তা হয় ক্ষমতা এবং সম্পদের উচ্চাবচ অবস্থান থেকে। এই ধরনের বৈষম্যদুষ্ট আলাপে সৌহার্দ গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কম।

গত কয়েক দশক ধরে ভারতে অর্থনৈতিক প্রগতি মূলত প্রযুক্তি-নিবিড় ক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীল। চাকরির বাজারে ঢোকার সবচেয়ে বেশি সুযোগ পেয়েছে প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষিত প্রার্থীরা। এই চাকরিজীবীরা রোজগারের একটা বড় অংশ বিনিয়োগ করেছেন জমি-বাড়ির বাজারে। এর ফলে ভূসম্পত্তির দাম বাড়তে বাড়তে ক্রমশ আর্থিক ভাবে পিছিয়ে-পড়া অংশের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছেন মুসলিমদের একটা বড় অংশও। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে আবাসস্থলের এই দূরত্ব ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। এই পিছিয়ে-পড়া অঞ্চলগুলিতে পরিকাঠামো দুর্বল, আধিকারিকদের নজরও হয়তো পাঁচ বছরে এক বার পড়ে। ফলে, প্রজন্মান্তরে উন্নয়ন ধীর লয়ে আসে। এই দুষ্টচক্রকে থামানো সোজা নয়।

শহরে এই পরিস্থিতি হলেও, গ্রামে হিন্দু-মুসলমান সহযোগিতার উদাহরণ বিরল নয়। এই কোভিড কালেই হিন্দু প্রতিবেশীদের দেহ সৎকার করার জন্যে এগিয়ে এসেছেন মুসলমান প্রতিবেশীরা। অতিমারির সময়ে এই ঘটনা বেশি করে চোখে পড়ে। এটা মানবধর্মের স্বাভাবিক প্রকাশ বলেই মনে করেন সকলে। অনেকেই নিজেদের স্মৃতি থেকে সহজ সহাবস্থানের নানা অমূল্য কাহিনি তুলে আনেন। প্রসঙ্গত মনে পড়ল, সদর-মফস্বল বইতে সুধীর চক্রবর্তী উল্লেখ করেছিলেন, এক হিন্দুর দেহ সৎকারে এগিয়ে এসেছিলেন গ্রামের মুসলমানরা। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বাইরে হিন্দু-মুসলমান তকমা থাকলেও এই নিম্নবর্গের মানুষগুলি প্রত্যেকেই ‘সাহেবধনী’ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। সেই সম্প্রদায় সমন্বয়বাদী, তাদের উপাস্য দীনদয়াল, যাঁর হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ নেই। তবে লোকধর্মের প্রভাব ছাড়াও, মৃত ব্যক্তির জাত ব্যবসা ছিল কামারশালা। ফলে, সামাজিক সম্পর্কের বাইরেও উৎপাদন-উপভোক্তা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল সব গোষ্ঠীর সঙ্গে। এমন বহুমাত্রিক আদানপ্রদান ধর্মের দূরত্ব কাটিয়ে দিতে পেরেছিল।

গ্রামে আন্তঃপ্রজন্ম উন্নতির হার, বিশেষত নিম্নবর্গের হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে, এখনও বেশ কম। আন্দাজ করা যায়, গ্রামের মানুষদের একটা বৃহৎ অংশ পরস্পর-সহায়ক ক্ষুদ্র শিল্পে নিযুক্ত। সেখানে উৎপাদনের স্বার্থ সুরক্ষিত করা বেশি জরুরি। এর ফলে পারস্পরিক দেখাসাক্ষাৎ, আদানপ্রদান অনেক বেশি হওয়ার সম্ভাবনা। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা (২০১২) অনুযায়ী, গ্রামে স্বনিয়োজিত শ্রমে নিযুক্ত মানুষের অনুপাত হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে সমান-সমান, দুই গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেই সংখ্যাটা প্রায় ৫০ শতাংশ। শ্রেণিগত দূরত্ব গ্রামে অপেক্ষাকৃত কম হওয়ার জন্য পরস্পর-বিচ্ছিন্নতা, অপরিচিতের দূরত্ব হয়তো শহরের চাইতে কম।

তবু প্রশ্ন থেকেই যায়, কেমন সেই কথাবার্তা, সেই আদান-প্রদান? তা কি অন্য ধর্মের মানুষকে নিজের ঘরে আমন্ত্রণ করে আনা, নিজের আহার ভাগ করে খাওয়ার দিকে এগিয়ে দেয়? নিজস্ব পরিচিতির সঙ্কীর্ণ খাঁচা ভেঙে মনুষ্যত্বের আকাশে ডানা মেলতে উদ্বুদ্ধ করে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Communal harmony Muslim hindu Secularism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE