Advertisement
০১ মে ২০২৪
স্বশাসন থেকে পঞ্চায়েত হয়ে উঠছে অনুদান বিলির দফতর
Panchayat

গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড

প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে খুঁজলে দেখা যায়, শ্রমিক কল্যাণে, শ্রমিক-স্বার্থ রক্ষায় তেমন কিছু করার সংস্থান নেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থার।

farmers.

গ্রামসমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল খেতমজুর। —ফাইল চিত্র।

সত্যব্রত পাঠক
শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০২৩ ০৪:৪৪
Share: Save:

পঞ্চায়েতের ভূমিকা কি শ্রমিক-কল্যাণ, শ্রম উন্নয়নে? বড় বড় শিল্প, মাঝারি কলকারখানা, শহরকেন্দ্রিক পরিষেবা ক্ষেত্রের বাইরে রয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতির এক বিস্তৃত জগৎ। সেখানে রয়েছেন খেতমজুর, দিনমজুর, নির্মাণ শ্রমিক, পাথর বা খড়ির খাদান, ইটভাটা, মাছের ভেড়ি, যাত্রী ও পণ্য পরিবহণের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকেরা। রয়েছেন গৃহকেন্দ্রিক উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল শিল্পের কর্মীরা, যাঁরা কেউ বিড়ি বাঁধেন, কেউ জরি-চুমকি বসান কাপড়ে। গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড এই মানুষগুলোর জীবিকার নিরাপত্তার বিষয়ে স্থানীয় সরকার, অর্থাৎ পঞ্চায়েতের ভূমিকা কী?

প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে খুঁজলে দেখা যায়, শ্রমিক কল্যাণে, শ্রমিক-স্বার্থ রক্ষায় তেমন কিছু করার সংস্থান নেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থার। সংবিধানের একাদশ তফসিলের অন্তর্গত ২৯টা বিষয় পঞ্চায়েতের কাজের জন্য নির্ধারিত, তার মধ্যে কোথাও শ্রমিক বা শ্রম বিষয়ক কোনও ক্ষেত্র নেই। সেই জন্যই পঞ্চায়েত সমিতি বা জেলা পরিষদে কোথাও শ্রম বা শ্রমিক বিষয়ক কোনও সমিতি নেই, নেই ‘শ্রম কর্মাধ্যক্ষ’ পদ। ফলে শ্রমিকের ভালমন্দ পঞ্চায়েতের কাছে গুরুত্ব পায় না।

অথচ, করার ছিল অনেক কিছু। গ্রামসমাজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল খেতমজুর। ন্যূনতম মজুরি আইন ছাড়া তার কল্যাণে আর কোনও শ্রম আইন নেই, আর সেই আইন রূপায়ণে সরকারি তরফে কোনও উদ্যোগ করা হয় না। খেত-মালিকের থেকে উপযুক্ত মজুরি প্রায়ই মেলে না, মেয়েদের সমান খাটিয়েও কম মজুরি দেওয়া প্রায় নিয়মে পরিণত। খোদ সরকারি কাজেও ন্যূনতম মজুরি প্রায়ই মেলে না। এই আইন রূপায়ণের দায়িত্বে থাকেন ব্লক স্তরের আধিকারিক— ন্যূনতম মজুরি পরিদর্শক। তাঁর উপর পঞ্চায়েতের কোনও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নেই। অনেক ব্লকে পরিদর্শকের পদ শূন্য। যাঁরা আছেন, তাঁরাও বেশির ভাগ সময়ই ব্লক অফিসে বিডিও-র দেওয়া অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন। এর সঙ্গে রাজনৈতিক চাপ, দুর্নীতি, এ সব তো আছেই।

এতে শ্রমিকের কতটা ক্ষতি হয়? অর্থনীতিবিদ অজিত নারায়ণ বসু রাজ্য সরকারের তথ্য থেকে দেখেছিলেন, নব্বইয়ের দশকে প্রত্যেক বছর ন্যূনতম মজুরির চেয়ে দৈনিক তিন থেকে আট টাকা কম পেয়েছেন দিনমজুররা। সেই হিসাবে দশ বছরে সাত হাজার কোটি টাকারও বেশি ঘাটতি হয়েছে শ্রমিকদের আয়ে। ওই সময়ে পঞ্চায়েতের মাধ্যমে গ্রামীণ দারিদ্র দূরীকরণের বিভিন্ন প্রকল্পে মোট যত টাকা খরচ হয়েছে, তা ওই মজুরি ঘাটতির ২৬ শতাংশেরও কম। আজ এই মজুরি ঘাটতির অঙ্কটা আরও বেড়েছে, এবং হিসাব করলে সম্ভবত দেখা যাবে, অনুদান বাড়া সত্ত্বেও মজুরি ঘাটতির অঙ্কের সঙ্গে তার ফারাক কমেনি, বরং বেড়ে থাকতে পারে।

রাজ্যে আছে প্রায় কুড়ি লক্ষ বিড়ি শ্রমিক, আরও কয়েক লক্ষ পাথরখাদান, ইটভাটা, নির্মাণ কাজে যুক্ত শ্রমিক, যাঁরা বেশির ভাগই পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা। এঁদের একটা বড় অংশ সিলিকোসিস, হাঁপানি, ফুসফুসের ক্যানসার ইত্যাদি পেশাগত রোগে আক্রান্ত। অথচ ডাক্তার শংসাপত্রে তাঁদের অসুখকে ‘পেশাগত রোগ’ বলে লিখে না দিলে শ্রমিক চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। নিয়োগকারী সংস্থার ডাক্তার প্রায়শই অসুখটিকে ‘পেশাগত রোগ’ বলেন না। ব্লক হাসপাতাল, প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসকরা কি পঞ্চায়েতের মধ্যস্থতায় এই আক্রান্ত শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় শংসাপত্র দিতে পারেন না? এ রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সাড়ে চার দশক পার করে ফেলল, অথচ শ্রমিক-কল্যাণে এই সামান্য উদ্যোগের কথা আজও ভাবা হল না।

বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে রাজ্যে বিকল্প কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ‘উৎকর্ষ বাংলা’ প্রকল্পকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। কিন্তু এই বিষয়ক জেলা কমিটিতে জেলা পরিষদের কোনও জায়গা জোটেনি। অথচ, পঞ্চায়েতের কাজের তালিকার মধ্যে কিন্তু কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের বিষয়টা রয়েছে। পঞ্চায়েতকে এলেবেলে করে রাখলে প্রকল্পের প্রকৃত উদ্দেশ্য মার খেতে পারে। কারণ, যে শ্রমিকদের বস্তুত প্রশিক্ষণের দরকার, যাঁদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নততর জীবিকা খুঁজে নেওয়ার সম্ভাবনা সর্বাধিক, তেমন উপভোক্তা শ্রমিকদের চিহ্নিত করা কঠিন হবে। নেতা বা আধিকারিকদের ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তিই সরকারি প্রশিক্ষণে নাম লেখাবেন। এ সব প্রকল্পের বাজেটে বরাদ্দও অপ্রতুল।

গ্রামের দরিদ্র, শ্রমজীবী মানুষের চোখ দিয়ে দেখলে গোটা পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকেই একটা মৌলিক প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে হবে। তা হল, পঞ্চায়েত কি আদৌ স্বশাসনের ইউনিট, না কি অনুদানের এজেন্ট? শ্রমিকের উন্নতির প্রশ্নে জড়িয়ে আছে অধিকারের রাজনীতি, স্বনির্ভরতার দর্শন। উন্নয়নমূলক কাজের দায় পঞ্চায়েতের উপর চাপানো হলেও, নিয়ন্ত্রণমূলক কাজ রয়ে গিয়েছে রাজ্য প্রশাসনের হাতে। প্রশাসনিক কর্তাদের চোখে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত এক স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান নয়, আর পাঁচটা সরকারি দফতরের মতো জেলা, ব্লক ও গ্রামের স্তরে কিছু দফতর, যা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া কার্যসূচি ও নির্দেশ অনুসারে চলবে, তার বেশি কিছু নয়। আর তাই পঞ্চায়েত অনুদান বিলি করে যদিও বা দুর্দশাগ্রস্তকে কিছু সহায়তা পৌঁছে দেয়, অধিকারের প্রশ্নে সে থেকে যায় স্থিতাবস্থার পূজারি। সেই অধিকারহীন উন্নয়নের মঞ্চে শ্রম-নির্ভর গ্রামবাসী ব্রাত্যই থেকে গেলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Panchayat rural areas village
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE