Advertisement
১৭ মে ২০২৪
allowance

সরকারি মঞ্চের বোবা গল্পেরা

সদ্য বিধবাদের ভাতা পেতে হলে আরও একটি মৃত্যুর অপেক্ষা করতে হয়। কোনও এক ভাতাপ্রাপক বিধবার মৃত্যু হলে তবেই তাঁরা প্যানেলে স্থান পাবেন।

সন্দীপন নন্দী
শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০২২ ০৫:০৬
Share: Save:

মাধবী হয়ে গিয়েছে ‘মাদবি’, কুসুম লেখা হয়েছে ‘কুছুম’, পমিতা র-ফলাহীন। এ কি বাংলা ভাষার দৈন্য, না কি অন্য কোনও বিপর্যয়? এক সরকারি অনুষ্ঠানে অনুদানের শংসাপত্র নিতে এসেছেন বিধবারা, তাঁদের জীবনের মতো তাঁদের নামের বানানগুলোও ভাঙাচোরা, ভুলভাল। সরকারি নথিতে সে সব নামই লেখা, ওই উচ্চারণ, ওই বানানই বৈধতা পেয়েছে। ওর আর সংশোধন হবে না, বদলাতে গেলে ভাতা বন্ধ। এই মেয়েদের নামের বানানে কার কি বা আসে যায়। ওঁদের নিজেদেরও ও নিয়ে মাথাব্যথা নেই, টাকাটা ঢুকলেই শান্তি।

সকাল সকাল বেলতাড়া, নন্দনপুর, গোকর্ণ, সিরসি থেকে এসেছেন ওঁরা। মঞ্চে উঠে মন্ত্রীর হাত থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিধবা ভাতার ‘ডামি’ চেক গ্রহণ করবেন। তার মাপ দু’ফুট-বাই-তিন ফুট। ছবিতে এই বড় মাপের চেক-এর ছবি উঠবে ভাল। সকলে বেশ স্পষ্ট দেখবেন, সরকারি সুবিধে প্রদান।

দর্শকের আসন ভরে গিয়েছে স্বামীহারা মেয়েতে। কেউ ছোট শিশু কোলে নিয়ে এসেছেন। একা আসতে সাহস না পেয়ে অনেকে সঙ্গে কাউকে নিয়ে এসেছেন, নগদ একশো টাকা আর ফেরার পথে মাংসভাত খাওয়ানোর শর্তে। সঞ্চালক খাতায় লিখলেন ‘বিশেষ ঘোষণা’, জেসমিন বেওয়ার অসুস্থতার কারণে ছেলে নেবেন চেক। লম্বা লাইন মঞ্চের পাশে। একে একে সিঁড়িতে উঠছেন তাঁরা। ‘আগুনের পরশমণি’ গান বাজছে। মঞ্চময় বাহারি ফুল, মুখ ঢেকে যায় চেকে। ছবি উঠছে। মেয়েদের গুঞ্জন কানে এল, এক জন পাশের বাড়ি থেকে ছাপা শাড়ি ধার করে পরে এসেছেন। প্রধান বলেছেন, “টাউনে একটু চকচকা হয়ে যেতে হবে মা।”

চেক-এর সঙ্গে পাওয়া শুভেচ্ছা বার্তায় কী লেখা? বেশির ভাগ মেয়ে এক লাইনও পড়তে পারলেন না। শেষ সারিতে কমবয়সি বিধবা মেয়েরা। সবার শেষে ডাক আসবে। ওদের অনায়াসে ডাক পড়তে পারত কলেজের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণের মঞ্চে, কিংবা খেলার প্রতিযোগিতার ভিকট্রি স্ট্যান্ডে। সেই সম্ভাবনা তৈরি হওয়ার আগেই তাঁদের বিয়ে, বৈধব্য, বিধবা ভাতার মঞ্চে ডাক পড়ার অপেক্ষা।

এ দিকে প্রেক্ষাগৃহের ‘বাহির’ লেখা দরজার নীচে কলরব। এক দল বিধবা ভিখারি ঢোকার চেষ্টা করছেন। অশান্তির ভয়ে পুলিশ আসে। এক সময় মাটিতেই বসে পড়লেন তাঁরা। নেতারা বার হলেই ধরবেন। তাঁরা তো শুধু স্বামীহারা নন, নথিহারা। পথেই সংসার। উদ্বাস্তু, ঘরহারা বিধবারা নিয়মের জাঁতাকলে সরকারি অনুদানের বৃত্তের বাইরে থেকে যান। আমন্ত্রণপত্রে নাম ওঠে না তাঁদের।

বিরতিতে তুলসীমালা গলায় এগিয়ে এলেন এক জন। অবিকল সত্যজিৎ রায়ের ছবির ইন্দির ঠাকরুনের মতো মুখ। বললেন, কাগজ থাকলেও আয়ের শংসাপত্রের অভাবে চার বার বাতিল হয়েছে তাঁর আবেদন। আয় কত? আয়ই নেই, তার আবার শংসাপত্র। প্রধান ফিরিয়ে দেন বছর বছর। আয়ের ঘরে শূন্য লেখা নাকি মানা। তাই ফুলমণি সাউয়ের আবেদন ‘রিজেক্ট’ হয়ে যায়।

সদ্য বিধবাদের ভাতা পেতে হলে আরও একটি মৃত্যুর অপেক্ষা করতে হয়। কোনও এক ভাতাপ্রাপক বিধবার মৃত্যু হলে তবেই তাঁরা প্যানেলে স্থান পাবেন। সে ভাবেই সভ্যরানি দাস এ বছর স্থান পেয়েছেন তালিকায়, বসে আছেন মাঝের সারির শেষ আসনে। সরকারি অফিসে থরে থরে সাজানো ফাইলের তালিকাগুলো থেকে একটি ঝরার অপেক্ষায় দিন গোনেন হাজার হাজার বিধবা। ভাতা পাওয়ার পরেও তাঁদের বছর বছর জানাতে হয়, বেঁচে আছি। সেই কাগজ ছাড়া ভাতা বন্ধ। এমনতরো মুচলেকা কেমন বেঁচে থাকার প্রমাণ, সে প্রশ্ন কে করবে? “হাজার টাকায় কী হয় স্যর?” ফিসফিস করে বললেন কোনার চেয়ারে সাদা সালোয়ারের গ্র্যাজুয়েট। এক বৃদ্ধা জানালেন, প্রতি মাসে ব্যাঙ্কে টাকা তোলার ফর্ম লিখতে দালাল নেয় দশ টাকা। এটিএম কার্ড নিতে সাহস হয়নি, কার্ডে ছেলেরা না জানিয়ে টাকা তুলে নিলে তিনি নাচার। তাই কষ্ট হলেও পয়লা তারিখে ব্যাঙ্কের লম্বা লাইনে দাঁড়ান তৃতীয় সারিতে বসে-থাকা বৃদ্ধাটি। একটু বাদেই তাঁর ডাক পড়বে।

মঞ্চে এক অশীতিপর বৃদ্ধা চেক নিয়েই সন্তানসম নেতার পা ছুঁলেন। দু’জনের মুখ দেখে বোঝা গেল না, কে কার কাছে ঋণী। কার ‘কৃতিত্ব’ ধরে রাখতে ছবি উঠে যায় একের পর এক। বক্তৃতা চলে। ফুলমালায় অতিথিবরণ হয়। শুধু ওই মেয়েদের কথা বলার সুযোগ হয় না। সে তো সময় নষ্টের শামিল। ওই এক হাজার টাকার চেকটাই খবর, বাকি সব অর্থহীন। পঁচাত্তর বছর হল স্বাধীনতা পেয়েছে দেশ, কিন্তু এই মেয়েদের স্বাধীন জীবনের সন্ধান দিতে পারেনি। এঁরা দেশের কাছে হাত পাতেন, কখনও পাত পাতেন। স্বাধীনতা এনে-দেওয়া লোকগুলোর উত্তরপুরুষরা যেন প্রকল্পের অন্নদাস হয়ে বেঁচে আছেন।

অনুষ্ঠান শেষ। আলো-মাইকের সংযোগ খোলেন কর্মীরা, দরজা বন্ধ করেন। বাইরে দাঁড়ানো গাড়িগুলো ফেরার পথে রওনা হয়। টিফিনের প্যাকেট বিতরণ চলে। এক হাতে চেক নিয়ে এগিয়ে এলেন এক জন। “ছেলের জন্য একটা দিবেন স্যর?” উত্ত‍র এল, “সব গোনাগুনতি। যা পেয়েছেন, ভাগ করে খান।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

allowance Government
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE