Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

অসাম্যের হাত ধরেই সংক্রমণ

হা সপাতালের বারান্দায় হতাশ হয়ে বসেছিলেন শাহনওয়াজ আলি হোসেন, বাড়ি বীরভূমের দুবরাজপুরে। বছর দশেক আগে প্রথম বার ধরা পড়ে যক্ষ্মা।

অনমিত্র বারিক
শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

হা সপাতালের বারান্দায় হতাশ হয়ে বসেছিলেন শাহনওয়াজ আলি হোসেন, বাড়ি বীরভূমের দুবরাজপুরে। বছর দশেক আগে প্রথম বার ধরা পড়ে যক্ষ্মা। বার তিনেক ডট্স (ডিরেক্টলি অবজার্ভড ট্রিটমেন্ট, শর্ট কোর্স) চালিয়ে, ওষুধ পালটে, ইনজেকশন চালু করেও যখন জীবাণু নির্মূল হল না, আলি পাড়ি দিলেন অধুনা ‘চিকিত্সার পীঠস্থান’ ভেলোরে, রোগমুক্তি লাভ করতে। লাভ হল না তেমন, কিন্তু বন্ধক দিতে হল তাঁর চালু দোকান। চেন্নাইয়ের এক বেসরকারি হাসপাতাল শনাক্ত করল: তাঁর যক্ষ্মাটি প্রতিরোধী— মাল্টি়ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিউবারকিউলোসিস (এমডিআর-টিবি)। ভারতে তখন এমডিআর-টিবির ওষুধ সরকারি ভাবে চালু হয়নি, খোলা বাজারে ওষুধের দাম আকাশছোঁয়া, খেতে হবে অন্তত দু’বছর। অগত্যা পরের ধাপ— কৃষিজমি বিক্রি। ২০১২-য় দু’বছরের ওষুধ যখন শেষ করলেন, তখন তাঁর ছোট মেয়ের এমডিআর-টিবি ধরা পড়েছে সরকারি হাসপাতালে, আর তিনি কিছুটা শ্রবণশক্তি হারিয়েছেন। শেষ দু’বছরের মধ্যে হারিয়েছেন এক কন্যাকে। আর এক কন্যা এমডিআর-টিবি ওষুধের বিক্রিয়ার কারণে মানসিক রোগাক্রান্ত।

পেলিগ্রি বাঁধ গড়ে উঠেছিল হাইতির প্রত্যন্ত এক গ্রামে, ডারলিনদের গোটা পরিবারকে উঠে আসতে হল ভিটেমাটি ছেড়ে, চলে গেল তার বাবার মূল উপার্জনের রাস্তাও। ডারলিন ও তার পরিবারের তিন জনের যক্ষ্মা ধরা পড়ল, পরবর্তী কালে জানা গেল ডারলিন এইচআইভি আক্রান্ত। ডারলিনের পেশা ডারলিন বেছে নেয়নি, বরং বাধ্য হয়েছে, তার ছোট ভাইবোনদের মুখ চেয়ে। কৃষিজমি চলে গেলে, আর কোন রাস্তাই বা খোলা থাকে ?

কিছু মিল পাওয়া যাচ্ছে কি? ওড়িশার নিয়মগিরিতে বক্সাইট খনন বা নর্মদায় বাঁধ গড়ার গল্প একই কথা বলে। তথাকথিত সভ্যতার ইতিহাসে বাস্তুচ্যুত মানুষদের স্থান নেই। কিন্তু সমান্তরাল সংক্রমণের ইতিহাস বলছে, ঘরবাড়ি হারিয়ে শরণার্থী শিবিরে থাকা মানুষদের শরীরে যক্ষ্মারোগের বাড়বাড়ন্ত লক্ষণীয়। ভাষার মিল নেই, মিল নেই সংস্কৃতির, কিন্তু সংক্রমণ দুই প্রান্তের মানুষদের একসূত্রে গেঁথে ফেলেছে।

চিকিত্সক পল ফার্মার তাঁর ‘ইনফেকশন অ্যান্ড ইনইকুয়ালিটিজ’ বইয়ে বলেছেন এই মানুষগুলোর কথা। তাঁর লেখায় কোথায় যেন মুম্বই, নিউ ইয়র্কের হারলেম, হাইতি, পেরু এক হয়ে গিয়েছে। ফার্মার দেখাচ্ছেন অধুনা আলোচ্য ‘কস্ট এফেক্টিভ’ বা ‘ননকমপ্লায়ান্স’ গোছের শব্দবন্ধগুলি উদ্ভাবিত হয়েছে শুধুমাত্র গরিবগুর্বো রোগী মানুষদের দোষারোপ করার জন্য। গবেষণা ও তথ্য বলছে, দারিদ্র ও অপুষ্টি, সংক্রমণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। চলতি ধারণা বলে, মানুষকে ঠিক ঠিক তথ্য দিয়ে শিক্ষিত করে তুললে রোগ কমে। ফার্মার এই ধারণাকে নস্যাৎ করেছেন। তিনি বলেছেন, রোগীরা যক্ষ্মার ওষুধ খায় না শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণে। এক দিন ওষুধ খেতে গেলে, এক দিনের রোজগার নষ্ট হবে বলে। এর কোনও বৌদ্ধিক বা সাংস্কৃতিক কারণ খুঁজতে যাওয়াটা বোকামি।

হাইতি, পেরু ও কিছুটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রর তথ্য দিয়ে দেখানো হয়েছে যে যক্ষ্মা ও এইচআইভি সংক্রমণ যতটা জীবাণু-নির্ভর, ঠিক ততটাই সামাজিক অসাম্য দ্বারা প্রভাবিত। একই সঙ্গে নৃতাত্ত্বিক এবং চিকিত্সক ফার্মার তাঁর লেখায় বলেছেন যে, মানুষ ঝুঁকি নেওয়ার অভ্যাস শখ করে রপ্ত করে না, সেই ঝুঁকি সে নিতে বাধ্য হয়। যত অসাম্য বাড়বে তত কমবে বেছে নেওয়ার সুযোগ। হাইতির গাইলিন ও মুম্বইয়ের লতার সঙ্গে ইলামবাজারের সাদিয়া জাহানের
মিল শুধু এইচআইভি সংক্রামিত বলেই নয়, তারা সমাজের চরমতম অসাম্যের শিকার। সমাজ তাঁদের দায়ী করে এই অবস্থার জন্য, অথচ পেশা খুঁজে নেওয়ার স্বাধীনতা সমাজই তাঁদের দেয়নি।

হাইতির এইচআইভি সংক্রমণের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর্যটকদের অন্য রকম ভাবে খুশি করতে গিয়ে তার আগমন, ধীরে ধীরে গেরস্থ ঘরে তার প্রবেশ এবং হাইতিতে প্রায় মহামারীর আকার ধারণ। ফলে পশ্চিমের মানুষ বয়কট করল হাইতিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে। গরিব হাইতি আরও গরিব হল, কাজের বাজার আরও কুঁকড়ে গেল, গাইলিনদের মতো হতভাগ্যদের সংখ্যা আরও বাড়ল। সেকেন্ড লাইন অ্যান্টিটিউবারকিউলার ড্রাগ, পেরুর রাজধানী লিমা’তে খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। অথচ যে মানুষগুলোর সবচেয়ে বেশি দরকার, তাঁরা ওষুধ না কিনতে পেরে এক শহর ছেড়ে আর এক শহরে জীবিকার তাগিদে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। এই যাত্রাপথে সংক্রামিত হচ্ছেন তাঁদেরই মতো হতভাগ্য আরও কিছু গরিব মানুষ।

অসাম্য এখানেই শেষ নয়। আমরা জানি যে মানুষের জীবনের মূল্য ক্ষেত্রবিশেষে আলাদা আলাদা। ‘কস্ট এফেক্টিভ’ তকমা লাগিয়ে একই অসুখ কোনও বিশেষ শ্রেণিভুক্ত মানুষের ক্ষেত্রে চিকিত্সার যোগ্য, আবার অন্য শ্রেণির ক্ষেত্রে নয়। এ কোন আধুনিক চিকিত্সা ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছি আমরা? ফার্মার দেখিয়েছেন, আমরা মুখে যা-ই বলি না কেন, আদতে কিন্তু দুটো পৃথিবী, এবং এই মুহূর্তে গরিবের পৃথিবীর জন্য কোনও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। পেরু বা হাইতির আন্তর্জাতিক সীমারেখা ভেদ করে পুঁজি আসে, আসে সংক্রমণ। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে রোগের প্রতিকারের জ্ঞান কাস্টমস অফিসের ঘেরাটোপে আটকে পড়ে।

যক্ষ্মা রোগ আবার ‘ফিরে এসেছে’, এই সরকারি দাবি অস্বীকার করে ফার্মার তথ্য সহ জানিয়েছেন— নিউ ইয়র্কের মতো ঝাঁ চকচকে আধুনিক শহরের হারলেম অঞ্চলে (যেখানে প্রধানত কালো মানুষ এবং অভিবাসীরা থাকেন) এক লক্ষ মানুষের মধ্যে প্রায় ২৫০ জন যক্ষ্মায় সংক্রামিত। যক্ষ্মা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে এসেছে অথচ হাইতি বা পেরুতে নয়, এই তথ্যের মধ্যে যুক্তির জোর নেই। আসল ঘটনা হল, যক্ষ্মা ছিলই, এখন তা সংবাদে ফিরে এসেছে।

আবার, যক্ষ্মার ওষুধ খেয়েও রোগ না সারার মূলে যে খিদে আর দারিদ্র, এই কথাটা আমাদের মাথায় থাকে না। যক্ষ্মারোগের সম্বন্ধে লিখতে বা বলতে গিয়ে সামজিক অসাম্যর ভূমিকাকে যতটা গুরুত্ব দিই, কাজেকর্মে ততটা দিই না। পৃথিবী জুড়ে রোগীকে দোষারোপ করার অভ্যাসটা একই থেকে গেছে, রোগী ওষুধ না খেলে তো দোষ তারই! তলিয়ে ভাবাটা আমাদের ধাতে নেই। ফার্মার চিকিত্সকদের যুক্তির শরণাপন্ন হতে বলেছেন।

বছর পনেরো আগে ডট্স থেরাপির অসহায়তার দিক তুলে ধরেছিলেন ফার্মার। তাঁর সংশয় ছিল, যেখানে যক্ষ্মার ওষুধের বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধের প্রাদুর্ভাব বেশি, সেখানে ডট্‌সের বিজয়রথ অচিরেই থেমে যেতে পারে। প্রায় কুড়ি বছর ধরে ডট্স ভারতে কয়েক কোটি যক্ষ্মা রোগী সারিয়ে তুলেছে, কিন্তু প্রতিরোধী যক্ষ্মাও তৈরি করেছে লক্ষাধিক। পর্যালোচনার এটাই ঠিক সময়। নীতি নির্ধারকদের এ ব্যপারে আগ্রহ কিঞ্চিৎ কম, তাঁদের অগ্রাধিকারের তালিকায় এমডিআর-টিবি নেই। আর এখন তো সব সময় বোঝানো হচ্ছে যে, এটা আত্ম-সুরক্ষারই যুগ, রাষ্ট্রের কোনও দায়িত্ব নেই।

চিকিত্সক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে ফার্মার-এর একটাই আবেদন— অসুখের উত্স অনুসন্ধানে ব্রতী হতে। পরিষেবার মাসুল গোনার ব্যবস্থাতে কারা স্বাস্থ্যের বৃত্তে আসতে পারছে আর কারা পারছে না, বা কী কারণসমূহ মানুষকে চিকিত্সকের কাছে (অথবা তাঁর থেকে দূরে) নিয়ে যায়, তা না জানলে চিকিত্সকরা রোগনির্ণয় নিয়ে সংশয়ের ঘেরাটোপে আটকে পড়বেন। রোগীর চিকিত্সা পাওয়ার অধিকার কখনওই বিমা কোম্পানি বা বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না, যারা পরিচালিত হয় উন্নত দেশের অগ্রাধিকার দ্বারা। শুধুমাত্র দামে পোষাবে না এই অজুহাতে
নতুন ওষুধপত্র হাইতিতে পৌঁছবে না— এ যুক্তি ধোপে টেকে না। চিকিত্সা হবে কি না, তা নির্ভর করে মারণব্যাধির রোগীর সামাজিক অবস্থানের ওপর। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। পকেট অনুযায়ী একই রোগের দুই সমান্তরাল চিকিত্সার ব্যবস্থা সভ্য-সমাজের পরিপন্থী।

সিউড়ি সদর হাসপাতালে চিকিৎসক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE