Advertisement
০৮ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

উত্তরাধিকার

ওবামা নিশ্চয় ভাবেন, পরিবারে সন্তানদের মধ্যে যে মূল্যবোধ বোনা হয়, জাতীয় রাজনীতিতেও সেই মূল্যবোধ থেকেই শুরু করা ভাল।

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ওবামা নিশ্চয় ভাবেন, পরিবারে সন্তানদের মধ্যে যে মূল্যবোধ বোনা হয়, জাতীয় রাজনীতিতেও সেই মূল্যবোধ থেকেই শুরু করা ভাল।

একে রোগা ডিগডিগে, তায় কিম্ভূত একটা নাম, বারাক হুসেন ওবামা! কেন, হুসেন কেন? মুসলিম না কি? না, মুসলিম তো নয়, খ্রিস্টান। তবে? যত্ত সব!

এত সব নিয়েও ছেলেটা অ্যাদ্দূর আসতে পারল? দেশের মাথায় একেবারে প্রেসিডেন্ট হয়ে বসল?

পারল যে, সেটা কিন্তু ছেলেটার নিজের দৌলতে নয়, দেশটার দৌলতেই। দেশটার নাম আমেরিকা কিনা— তাই।

এই পুরোটাই ২০০৮ সালে প্রথম বার প্রেসিডেন্ট হয়ে ওবামা বলেছিলেন একটি বক্তৃতায়। অতীব সুবক্তা, তাই কথার স্টাইল হিসেবেই নিয়েছিলেন অনেকে। অথচ কথাগুলো কিন্তু নিছক স্টাইল ছিল না, কিছু গভীরতর ছিল। গভীরতাটা পরের আট বছরে আরও পরিষ্কার হল। কত বার তিনি আমেরিকার বিচিত্র মেলানো-মেশানো চরিত্রের অ-সাধারণত্বের উপর জোর দিয়েছেন, কত বার বলেছেন আমেরিকার আমেরিকাপনা এখানেই! অসম্ভব গর্বিত তিনি এ নিয়ে, প্রায় অহঙ্কারী হলা চলে। তবে এই অহঙ্কারে অহম্ যতটা, তার থেকে আমাকে আমার দেশ কী করেছে দেখো, সেই অহম্–খানাই বেশি জোরালো। নিজে কালো বলে, মুসলিম না হয়েও মুসলিম নামের বাহক বলে, লিবিয়া ইন্দোনেশিয়া নানা দেশের সঙ্গে আইডেন্টিটি জড়িয়ে আছে বলেই হয়তো তিনি এ ভাবে ভাবতে পেরেছেন। কোথায় আমেরিকা সবচেয়ে আলাদা, তা নিয়ে অহঙ্কার তৈরি হয়েছে।

এও কিন্তু ‘আমেরিকা ফার্স্ট’-এরই ঘোষণা। শুধু— কোন দিক থেকে আমেরিকা ‘ফার্স্ট’, সেটা অন্য ভাবে দেখা। অন্য গলায় ঘোষণা।

আশ্চর্য নয়, এই আট বছরের মধ্যেই সমলিঙ্গ বিবাহ নিয়ে সে দেশে কয়েক পা এগোনো গিয়েছে। আশ্চর্য নয়, এর মধ্যেই ‘ব্ল্যাক লাইভস্ ম্যাটার’ আন্দোলন ঘটেছে। এ সবের ফলে রক্ষণশীল সমাজের গভীর ও ব্যাপ্ত বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ঘটেছে, সেটাও ঠিক। কিন্তু ওবামা ও ডেমোক্র্যাটরা আজ পরাজিত পক্ষ বলে প্রতিক্রিয়াটাকেই জোর দিয়ে দেখব, আর এই আন্দোলন আর অগ্রগতিগুলোকে ছোট করে দেখব, এটা ঠিক নয়। কেনই-বা দেখব? ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক ভোট পেয়েছেন, এটা যেমন ভাবার মতো ঘটনা, তেমনই মানুষের ভোটের হিসেবে যে ট্রাম্পের চেয়ে হিলারি ক্লিন্টন দশ লক্ষেরও বেশি ভোট পেয়েছেন, সেটা ভাবার দরকার নেই বুঝি? আমেরিকার মধ্যে আজ অনেকগুলো আমেরিকা, তাদের সকলেরই গলার জোর আগের থেকে বেশি, পরস্পরের বিরুদ্ধে রাগ ক্ষোভও বেশি। কিন্তু তা বলে ওবামা যে-আমেরিকার অহঙ্কারে অহঙ্কারী, সেটাকে মিথ্যে বলে ভাবাটা বিরাট ভুল হবে। লিবারেল আমেরিকাকে যে ওবামা এগিয়ে দিয়ে যাননি, সেটা ভাবাও ভুল হবে।

সে দিন বক্তৃতায় নিজের উদাহরণ দিয়ে ওবামা নিজের দেশটাকেই বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। দেশের যে সত্তাটাকে আদর্শ জাতীয় মূল্যবোধ হিসেবে তুলে ধরতে চান, সেটাই মনে করিয়েছিলেন। এই তাঁর স্টাইল। ব্যক্তিগত জীবনটাকে বৃহত্তর জাতীয় জীবনের আয়না করে ফেলা।

ঠিক সেই কারণেই, ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারে যখন অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার চলছে, সাদা আমেরিকার দুর্গ রক্ষার পরিকল্পনা চলছে, ওবামারা স্বামী-স্ত্রী তখন নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানালেন দুই কন্যার কথা দিয়ে। টেলিভিশনে ট্রাম্পের বক্তৃতা শুনে মেয়েরা অবাক-চোখে বিপর্যস্ত বাবা-মার দিকে তাকাতে কী ভাবে তাঁরা ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, এত দিনের শেখা মূল্যবোধগুলো নতুন করে মনে করিয়ে দিলেন— দেশবিদেশের সবাই জানতে পারলাম। ব্যাপারটা সামান্য নয়। আর কোন প্রেসিডেন্ট এমন অকপটে ঘরের কথা দুনিয়ার সামনে হাট করেেছেন আগে? গভীর রাজনীতির সংকটেও আটপৌরে পারিবারিক ঘটনার কথা বলে জনসংযোগ করেছেন?

শেষ সাক্ষাৎকারটিতেও এক ব্যাপার। যাওয়ার আগে
কী বার্তা দেবেন ওবামা? জানালেন, মেয়েদের বলেছেন, বিশ্বাস না হারাতে, পড়ে গেলে ধুলো ঝেড়ে উঠে আবার দৌড়তে।— বুঝ নাগরিক যে জান সন্ধান।

ওবামা নিশ্চয় ভাবেন, পরিবারে সন্তানদের মধ্যে যে মূল্যবোধ বোনা হয়, জাতীয় রাজনীতিতেও সেই মূল্যবোধ থেকেই শুরু করা ভাল। রাজনীতি তো রোজকার জীবনের বাইরের বিষয় নয়। মানুষে মানুষে সম্পর্ক, অন্যের প্রতি দায়িত্ব, আচরণ, এগুলো ঠিক হলেই সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ভিতগুলো একে একে তৈরি হবে। নতুন কথা নয়, বৈপ্লবিক তো নয়ই। রোজকার মূল্যবোধের দিয়েই লিবারেল রাজনীতি তৈরি করা। ওবামার নিজস্ব স্টাইলে ব্যক্তিগত ও জাতিগত রাজনীতির দৃপ্ত মিশেল সেটাই বলে গেল।

ব্যক্তিজীবন যে কত ভাবেই জাতীয় জীবনের প্রতিফলন! আমেরিকান স্বপ্নের এত বিজ্ঞাপন সত্ত্বেও আমেরিকা স্বপ্নের দেশ নয়: তাই প্রথম কালো প্রেসিডেন্ট হতে কত শতাব্দী কেটে যায়, কালো বলে কালো সাদা সবাই তাঁকে সন্দেহ করে, পিতৃদত্ত মধ্যনাম জঙ্গি ইসলামের সঙ্গে লিপ্ততার অভিযোগ তোলে, ‘প্রেসিডেন্ট ওসামা’র নামে স্লোগান চলে। তাঁর রাজনীতির থেকেও ‘তিনি’ ব্যক্তিটি যেন অনেক বড় টার্গেট।

অথচ ব্যক্তির উপরে উঠে কেবল রাজনীতির ভাষাতেই আক্রমণ করা যেত। অন্ধ ভক্ত ছাড়া কেউ বলবে না যে রাজনীতিক হিসেবে ওবামা সফল। ভিশনারি, অর্থাৎ রাজনীতি-দর্শনে তিনি যতটা দিকপাল, হাতেকলমে তার ধারে-কাছেও নয়। রাজনৈতিক পার্টি কেমন করে চালাতে হয়, কংগ্রেসে কেমন করে সমর্থন টানতে হয়, এ সব প্রাথমিক রাজনৈতিক ব্যাকরণে তাঁর পারদর্শিতা বেশ কম। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। বন্দুক নিয়ন্ত্রণ-এর মতো প্রগতিশীল সংস্কার ধুলোয় পড়ে থেকেছে। সুলভ স্বাস্থ্যবিমা নীতি ওবামাকেয়ার ‘এক্সিকিউটিভ অর্ডার’ দিয়ে পাশ করাতে হয়েছে। সমলিঙ্গ বিবাহ নিয়ে আইনের বদলে সুপ্রিম কোর্টের রুলিং-কেই সিলমোহর দিতে হয়েছে। পরের প্রেসিডেন্ট এসে পাল্টা এক্সিকিউটিভ অর্ডার দিয়ে এগুলো বেবাক পাল্টে দিতে পারেন। ট্রাম্প প্রথম দিন অফিসে ঢুকেই অর্ডার দিয়েছেন: ‘ওবামাকেয়ার’-এর রোলব্যাক।

তা হলে? হাতে থাকল না কিছুই? আট বছরের শেষে?

আইনকানুন, সংস্কার, নির্বাচনী হিসেবের যে হাতেকলমে রাজনীতি, তাতে বেশ কম নম্বর নিয়েই গেলেন ওবামা। কিন্তু অন্য একটা বিষয়ে তিনি গাদা-গাদা নম্বর পেয়ে রেখেছেন। রাজনীতির একটা মানবিক মুখ, প্রায়-হারিয়ে-যাওয়া মুখটিকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন। এ বিষয়ে তিনি আজকের দুনিয়ায় ফার্স্ট, সাম্প্রতিক ইতিহাসেও ফার্স্ট। তাঁর সময়ের দুনিয়া সহজ নয়, এখানে বহু মানুষ ‘মানবিক মুখ’-এর উল্টো মুখটাকেই আলিঙ্গন করতে চান। ওবামা টলেননি।

২০ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর পাঠানো ভিডিয়ো বার্তায় তিনি জানালেন, শিকাগোতে এ বার তাঁর নতুন প্রজেক্ট, প্রত্যক্ষ জনসংযোগের রাজনীতির সেন্টার বানানো। মানুষ নিজেরা এসে বলবেন, রাজনীতি নিয়ে তাঁদের কী কী ভাবনা। ‘কী করা যায়’ থেকেই শুরু হবে ‘করা’। অর্থাৎ সেই মানবিক যোগেরই রাজনীতি, আরও সরাসরি।

এই যে তাঁর অলজ্জ একবগ্গা গোঁয়ার মানবিক মুখ— এটাই ওবামার আসল উত্তরাধিকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE