Advertisement
১১ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

তলে তলে এই!

হয়নি, হয়নি, ফেল: ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে চোখ মটকে আমরা গোটা দুনিয়ার কুচকুচেরা হইহই শুরু করব এ বার! যে অঙ্কটা অ্যাদ্দিন কষলেন, সেটা মেলেনি স্যর, মেলানো যাবে না।

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

হয়নি, হয়নি, ফেল: ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে চোখ মটকে আমরা গোটা দুনিয়ার কুচকুচেরা হইহই শুরু করব এ বার! যে অঙ্কটা অ্যাদ্দিন কষলেন, সেটা মেলেনি স্যর, মেলানো যাবে না। স্রেফ মেলানিয়ার জন্যই মেলানো যাবে না। এমন একটা কাঁপিয়ে দেওয়া প্রচার করলেন, টেনশনে খানখান করে জয় ছিনিয়ে আনলেন, এ দিকে তাঁর নিজের ঘরনিই যে সমস্ত প্রচার ফেল করিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, সেটা খেয়াল করলেন না? মেলানিয়া ট্রাম্প যখন আগামী সপ্তাহে ফার্স্ট লেডি হয়ে হোয়াইট হাউসে ঢুকবেন, সেই মুহূর্তেই যে প্রেসিডেন্ট-মশাইয়ের সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে, তাঁর কোনও ডায়ালগই যে তিনি নিজের জীবনে সিরিয়াসলি নেননি, সেটা ঝকঝক করে ফুটে উঠবে, এটা কি আগে ভাবেননি ট্রাম্প!

না, আরও ভুল। মেলানিয়া ট্রাম্প তো হোয়াইট হাউসে ঢুকবেন না। ঢুকলেও কয়েক দিন পরই বেরিয়ে যাবেন, সেখানে থাকবেন না। বেচারা ডোনাল্ড কি সেটাও আগে তলিয়ে দেখেননি? হোয়াইট হাউসে বউ-এর থাকা-না-থাকা দিয়েই যে শুরু হবে তাঁর নাকালপনা! আমেরিকার এতদিনকার ঐতিহ্য— হোয়াইট হাউস থেকে বেরিয়ে যাবেন এক প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবার, বসবাস করতে ঢুকবেন আর এক প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পরিবার। এ বার, ২০১৭ সালে, পঞ্চান্নতম প্রেসিডেন্টের আমলে সেই ঐতিহ্য ভেঙে প্রথম ব্যতিক্রম হতে চলেছে। মেলানিয়া ট্রাম্প বলে দিয়েছেন তিনি হোয়াইট হাউসে একদম থাকবেন না, ওয়াশিংটনেই থাকবেন না। তিনি থাকবেন তাঁর জায়গায়, ডোনাল্ড থাকবেন নতুন আবাসে। লং-ডিসট্যান্স ফ্যামিলি, যাকে বলে। আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম লং-ডিসট্যান্স ফার্স্ট ফ্যামিলি।

দিনকাল যেমন পড়েছে। ওবামার মতো একেবারে ঐতিহ্যবাহী ‘ফ্যামিলি-ম্যান’ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর ‘ডিফারেন্ট ফ্যামিলি’! কী বৈপরীত্য! ওবামা পরিবার-অন্ত প্রাণ, তাঁর পরিবার চিরন্তন হাম দো, হমারা দো। ট্রাম্পের পরিবার ‘অন্য রকম’। ওবামার একটিই বিয়ে, তাঁর স্ত্রী তাঁর জীবন-ভর ভালবাসা, ট্রাম্পের তিনটি বিয়ে, তৃতীয় বউ মেলানিয়া প্রথম আলাপের সময়ে তাঁকে ফোন নম্বর দিতে চাননি— দুশ্চরিত্র বলে তখনই এত নামডাক ডোনাল্ডের। ওবামার স্ত্রী মিশেল প্রাণ-উৎসর্গীকৃত মা। ট্রাম্পের স্ত্রী মেলানিয়া বাইশ শতকের যৌবনতরঙ্গিণী, আগাপাশতলা ‘মডেল’, খোলামেলা ছাড়া জামাকাপড় পরেন না। বারাকের সব কাজে মিশেল তাঁর সঙ্গী। মেলানিয়ার জন্য গৃহিণী সচিব শিষ্যা কোনও শব্দই চলবে না, কোনওটাই তিনি হবেন না, হতে চানও না।

ডোনাল্ডের নির্বাচনী প্রচারে বেশি দেখা যায়নি মেলানিয়াকে। দেখা গেলেও কথা বলতে শোনা যায়নি। শোনা যাবে কী করে? তিনি ‘বিদেশিনি’, তাঁর কথায় প্রবল অ-মার্কিন টান। কী বলবে লোকজন, ডোনাল্ডের সমর্থকরা? অভিবাসী সমাজের বিরুদ্ধে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগুনখেকো বক্তব্য শুনে যাদের রক্ত টগবগ করে ফোটে? সুদূর স্লোভেনিয়ার সুন্দরীকে স্ত্রী হিসেবে বগলদাবা করেছেন সেই একই অভিবাসীবিরোধী জাতীয়তাবাদী ডোনাল্ড, কথাটা কি লোকসমক্ষে বেশি প্রচার করা যায়? নিজের অন্তঃপুরবাসিনীই দস্তুরমতো অভিবাসিনী, এই অবস্থায় অভিবাসী-ঠ্যাঙানো নীতিতে জনতাকে খেপানো যায়? মেলানিয়াকে খুব করে সামলেসুমলে রাখতে হয়েছিল তাই। এক বারই রিপাবলিকান ন্যাশনাল কনভেনশনে মেলানিয়াকে বক্তৃতা দিতে শোনা গিয়েছিল, কী কাণ্ড সেই বক্তৃতা নিয়ে। আগাপাশতলা সেটা মিশেল ওবামার স্পিচ থেকে টোকা। আহা, কেউ একটু ভেবে দেখল না, বেচারি হয়তো ইংরেজিতে কাঁচা বলেই এত টোকাটুকি। বিদেশিরা, বিশেষত পূর্ব ইউরোপীয়রা তো ইংরেজিতে কাঁচাই হয়!

পুব ইউরোপের তলার দিকের ছোট্ট নতুন দেশ স্লোভেনিয়ার মেয়ে মেলানিয়া। সেই স্লোভেনিয়া, ১৯৯১ সালের আগে যার নাম ছিল যুগোস্লাভিয়া। সেই যুগোস্লাভিয়া, কমিউনিস্ট দেশ বলেই ইতিহাসে যার পরিচয়। সেই দেশ, ২০০৭ সালে প্রথম কমিউনিস্ট দেশ হিসেবে যে ইউরোজোন-এ ঢুকতে পেরেছিল। কী কাণ্ড, ডোনাল্ড ট্রাম্প! এত বড় বড় কথা বলে, আমেরিকা ছাড়া সবাই নিপাত যাক, এই সব ধুয়ো তুলে, তলে তলে এই? কেবল অভিবাসী নয়, একেবারে মার্কামারা কমিউনিস্ট দেশের ইংরেজি-কম-জানা অভিবাসী বউ? দুশো বছরের আমেরিকায় এমন ছিষ্টিছাড়া কাণ্ড কেউ শুনেছে? দুশো বছরে মেলানিয়াই প্রথম ফার্স্ট লেডি যিনি আমেরিকায় জন্মাননি। এবং অবশ্যই প্রথম ফার্স্ট লেডি যিনি হাড়শত্রু কমিউনিস্টদের দেশে জন্মেছেন, বড় হয়েছেন। এবং— অবশ্যই একমাত্র ফার্স্ট লেডি যিনি ভাবী প্রেসিডেন্ট স্বামীকে বিয়ে করার সময় পর্যন্ত— আ ছি ছি— মার্কিন নাগরিক ছিলেন না। মার্কিন পাসপোর্ট তিনি পেয়েছেন ডোনাল্ডের সঙ্গে বিয়ের গোনাগুন্তি এক বছর পর।

তবে, ইংরেজি কম জানলে কী হবে, পাঁচ-পাঁচটা ভাষায় কাজ চালাতে পারেন মেলানিয়া। ফরাসি, জার্মান, স্লোভেনিয়ান, সার্বিয়ান আর ইংরেজি। এত দিন অবধি ফার্স্ট লেডিরা বিদেশি ভাষা জানলে স্প্যানিশ-ফরাসি, নিদেনপক্ষে জার্মান অবধি ছিল তাঁদের দৌড়। তার জায়গায় এই সব অপরিচিত ‘ইক্সোটিক’ ভাষা? করেছেন কি ডোনাল্ড?

অবশ্য তাই বলে প্রগতিবাদীরা মেলানিয়াকে প্রগতি আর বিপ্লবের শেষ কথা মনে করতে একদম নারাজ! মেলানিয়া রেড ক্রসের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে কাজ করেছেন বটে, কিন্তু তাও তাঁকে পাতে তোলার যোগ্য মনে করেন না লিবারেল মার্কিনরা। হোয়াইট হাউসের বাঘা বাঘা মহিলা ব্যুরোক্যাটদের মতে, বৈচিত্র, বহুসংস্কৃতি, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ইত্যাদিকে প্রভূত মূল্য দিয়ে এলেও তাঁরা মোটেই নতুন ফার্স্ট লেডির সঙ্গ পেতে উৎসুক নন! হয়তো এই প্রবল বাধা টের পেয়েই মেলানিয়া হোয়াইট হাউসে থাকার সম্ভাবনাটা মাথায় রাখেননি। ওই নেত্রী-কর্ত্রীরা তো প্রকাশ্যেই বলেছেন, রুচি ও জীবনযাপন দিয়ে মেলানিয়া ভয়ানক রকমের ‘অন্য রকম’! নির্বাচনী প্রচারে যেটুকু ইতিউতি দেখা গিয়েছে, তাতেও তাঁর ‘অন্য রকম’ পোশাক-আসাক, হাবভাব, চালচলন টের পেয়েছে সুভদ্র বিশ্বলোক। ফলে মেলানিয়া ‘মেনস্ট্রিম’ বা মূলস্রোতের নন, ডিকশনারি থেকে উঠে আসা ‘মার্জিনাল’ বা প্রান্তিক মডেলের প্রতিনিধিও নন। রক্ষণশীল ও প্রগতিশীল, সব শিবিরের বাইরে তিনি। সর্ব অর্থেই বহিরাগত। এমন বহিরাগত মেয়ে হোয়াইট হাউসের কর্ত্রী এ বার? এ কি বিপ্লব? না কি রসাতল?

কে জানে কী! তবে একটা কথা ঠিক। সাদা মার্কিনি জাতীয়তাবাদ ও রক্ষণশীল আমেরিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বেচারা নতুন প্রেসিডেন্ট-মশাইয়ের দুটো আদর্শের সঙ্গেই একশো শতাংশ বেখাপ্পা তাঁর স্ত্রী। ফার্স্ট লেডির এই আগাপাশতলা বেখাপ্পাপনাই কি যথেষ্ট বিপ্লব নয়? অন্তত একটা অন্তর্ঘাত, যাকে বলে ‘সাবভার্শন’?

কে জানে, মেলানিয়াই হয়তো ট্রাম্পের শ্বেতপ্রাসাদে চুপিসাড়ে ঢুকে পড়া কালো সাপ? কিংবা, কালসর্প?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE