Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Power of Poem

সম্পাদক সমীপেষু: কবিতার শক্তি

কবিতার শক্তিটা ঠিক কোথায়, আমরা অ-কবিরা ঠাহর করতে পারি না। সেটা কবিতার ছন্দ হতে পারে। ছন্দহীন কবিতারও ছন্দ থাকে। সুর থাকে।

শেষ আপডেট: ০৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:৩৪
Share: Save:

গাজ়া ভূখণ্ডের কবিরা চিরনির্যাতিত, সেখানে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তেরো জন কবিকে হত্যা করা হয়েছে— বলেছেন কবি সুবোধ সরকার তাঁর ‘কবিকে কেন এত ভয়’ (২৪-৩) শীর্ষক প্রবন্ধে। শেষে করেছেন এক শক্তিশালী মন্তব্য— ভারতের প্রতিটি ভাষায় কবিতা লেখা হয় যা আস্তে আস্তে আবিষ্কৃত হচ্ছে এবং এই সমস্ত কবিতা এক জায়গায় জড়ো হলে সারা ভারত হয়ে উঠবে একটি ‘গ্লোবাল পাওয়ার’, যেটা পাঁচটা নোবেলের চেয়েও শক্তিশালী।

কিন্তু কবিতার শক্তিটা ঠিক কোথায়, আমরা অ-কবিরা ঠাহর করতে পারি না। সেটা কবিতার ছন্দ হতে পারে। ছন্দহীন কবিতারও ছন্দ থাকে। সুর থাকে। সুরের কাজ হল কথাকে ভাব জুগিয়ে তাকে নিয়ে মর্মে ঢুকে পড়া। এ ভাবে হয়তো কবিতা হৃদয়গত হয় এবং শক্তি জোগায়। অর্থাৎ, কবি পাঠককে শক্তি জোগান।

আবার কবিতা সরাসরি কথা বলে না, সহজে ধরা দেয় না সব কবিতা। একটু ঘুরপথে রহস্যময়তা নিয়ে আসে। অন্তরকে প্রস্তুত করতে নানা রকম জুতসই উপমা থেকে শক্তি সঞ্চয় করে সে পাঠকের কাছে হাজির হয়।

কবিকে রাষ্ট্র কেন ভয় করে? কবিরা সংগঠিত নন, তবুও ভয় রাষ্ট্রের। তিনি বিরুদ্ধে বলছেন না, অথচ বলছেন। হাজার রকম বৈষম্য গুঁড়িয়ে মানুষের সাম্যের কথা বলছেন। যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে কথা বলছেন না, তবে তাঁর কথা অযৌক্তিক নয়। মঞ্চ কাঁপিয়ে বক্তৃতা দিয়ে বোঝাচ্ছেন না। লেখনী চালনায় যতটুকু শব্দ হয় তেমন করে বলছেন। এমন ভাবে বলা যে সরাসরি মরমে প্রবেশ করে নান্দনিক চেতনাকে জাগ্রত করে। সেই ভাবে বলাই কবিতা। সততা যে সুন্দর, প্রকৃতি যে সুন্দর, মনুষ্যত্বই যে সত্য, সেই সত্যই যে সুন্দর, এমন সৌন্দর্যবোধের নির্মাণ কবিতা ছাড়া কে করবে? এই সৌন্দর্যবোধ যার মধ্যে তৈরি হয়েছে, সে রাষ্ট্রের অন্যায়কে প্রশ্রয় দেবে না। তাই কবিতাকে রাষ্ট্রের ভয়, কবিকে রাষ্ট্রের ভয়। শিল্পীদেরও রাষ্ট্রের ভয়।

মানুষের প্রতি কবিদের এই দায়বদ্ধতার জন্য মানুষ তাঁদের উপর আস্থা রাখেন, বিশ্বাস করেন। সুতরাং, রাষ্ট্রকে ভয় পেতে হবে। ভয় পেয়ে সে চাইবে প্রথমে কবিদের বাগে আনতে, স্বপক্ষে টানতে। না পারলে ‘গাজ়ার কবিদের দশা দেখো।’

দুর্গেশকুমার পান্ডা, নরেন্দ্রপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

অস্থিমালা

সুবোধ সরকারের প্রশ্ন: “কবিদের উপর রাষ্ট্রের এত রাগ কেন?” প্রতিস্পর্ধী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ভুখা এবং শোষিত মানুষের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে লিখেছিলেন— “আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি,/ প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।” কবিতার নাম: ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি’। মাত্র ২১ বছর বয়সে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে কবির মৃত্যু হলে সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর স্মৃতিচারণ করে লিখলেন— “আমি বিশ্বাস করি ইতিহাসের অমোঘ অস্ত্রশালায় এই কবি দধীচির অস্থিমালা দিয়ে যে বজ্র তৈরি হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে বঞ্চিত মানুষের বুকে তার ক্ষমাহীন নির্ঘোষ শোনা যাবে।”

আসলে এই ক্রমবর্ধিত অসাম্য ও শ্রেণিবিভাজিত সমাজে প্রতিবাদী, গণসংগ্রামী ও চেতনাদীপ্ত কবিরা রয়েছেন, যাঁরা নিপীড়িত-বঞ্চিত-শোষিত মানুষের জন্য নিজেদের সম্পূর্ণ ভাবে সঁপে দেন; তাঁরা জীবন দিয়ে লিখে যান প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও মানবমুক্তির ইস্তাহার। যে-হেতু রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু কোনও ভাবেই এমন উৎসর্গীকৃত কবিদের বলিষ্ঠ গণকণ্ঠকে দমন করতে পারে না, তাই কবিদের প্রতি রাষ্ট্রের এতটা ভয় বা আশঙ্কা।

প্রবন্ধকার বিশ্বের অনেক প্রতিস্পর্ধী কবির প্রসঙ্গ ও তাঁদের আত্মবলিদানের কথা উল্লেখ করেছেন। এখানে স্মরণ করা যায় আর একটি নাম— স্পেনের মহান কবি ও নাট্যকার ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা (১৮৯৮-১৯৩৬)। ১৯৩৬ সালের এক গ্রীষ্মে, ১৯ অথবা ২০ অগস্ট স্পেনের স্বৈরাচারী শাসক জেনারেল ফ্র্যাঙ্কোর বাহিনীর হাতে বিনা বিচারে তিনি খুন হন। সেই সময় জীবনের অধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষায় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কবির ছিল বর্ণময় সক্রিয় লড়াই। কবির কবিতা-নাটক-লিরিক-ব্যালাডে উঠে আসে বহু সংস্কৃতির যোগসূত্র। ইউরোপের সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে, স্প্যানিশ নাটক ও সাহিত্য-ধারাকে উজ্জ্বল করে তুলতে তিনিই ছিলেন অন্যতম। তাই প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থী শক্তি গৃহযুদ্ধের সময় তাঁকে শহরের বাইরে এক দুর্গম পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

আর আমাদের দেশে? ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতি অবিচল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং এক উত্তাল সময়ে অসাম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে অবিচ্ছেদ্য লড়াইয়ে সমর্পিত এক বিক্ষুব্ধ জীবনসত্তা— কবি সরোজ দত্ত (১৯১৪-১৯৭১)-র নাম এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা না হলে, সেটা হবে সত্যেরই অপলাপ। অন্যায় ও স্বার্থোদ্ধত অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী হয়ে উঠেছিল আত্মপ্রত্যয়ের তর্পণ। ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক সাহিত্যের প্রতি তাঁর ছিল গভীর পাণ্ডিত্য। চেন-ই’র কবিতা অনুবাদ করে কবি লিখেছিলেন, “বিশবছর ধরে আশার মশাল জ্বলছে দক্ষিণে,/ আমার ছিন্ন শির যদি আজ দূর্গপ্রাকারে ঝোলে, ঝুলুক।/ তোমরা যারা রইলে এগিয়ে যেও দ্বিগুণ উদ্যমে...।” কবিরা কি ভবিষ্যদ্বক্তা হন? শেষ পর্যন্ত কবি সরোজ দত্তের মুণ্ডহীন শরীরটা সত্যিই পাওয়া গিয়েছিল ভোরবেলায় ময়দানে, তারিখটা ছিল ৫ অগস্ট, ১৯৭১ সাল। দীর্ঘ কাল অতিক্রান্ত, তাঁর হত্যারহস্য ও তদন্তের ফলাফল আজও প্রকাশ্যে আসেনি।

কবি সরোজ দত্তের এমন ভয়ঙ্কর পরিণতির সঙ্গে স্পেনের কবি লোরকার চরম হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ঠিক কতটা মিল? দধীচির অস্থিমালায় সৃষ্ট প্রতিরোধী জীবনাশ্রয়ী কবিরা যখন মুক্তির মহাকাব্য রচনা করতে গিয়ে এ ভাবে নির্বিকারে প্রাণ দিয়ে যান, তখন প্রশ্নটা কি এ ভাবেও উঠে আসে না— কবিরা রাষ্ট্রকে ভয় পাবেন কেন? রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘এবার ফিরাও মোরে’ স্মরণ করে শেষে বলতে হয়— “...মৃত্যুর গর্জন/ শুনেছে সে সংগীতের মতো।”

পৃথ্বীশ মজুমদার, কোন্নগর, হুগলি

শুধু ক্যান্টিনে

‘কবিকে কেন এত ভয়’ প্রবন্ধে প্রবন্ধকার এক দিকে যেমন আশাবাদ, তেমনই অন্য দিকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কবিদের ‘গ্লোবাল পাওয়ার’-এর কথা বলে কবিতার ক্ষমতাকে সবার সামনে তুলে ধরেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, যে কবি গোটা বিশ্বের খবর রাখেন, তিনি হয়তো বাংলার খবর রাখেন না। কারণ কবিতাকে ‘গ্লোবাল পাওয়ার’ হতে গেলে বাংলাকেও দরকার, আর সেই বাংলাতে কবিদের আদর্শের ডিগবাজি খেতে দেখা যায়, শাসকের অত্যাচার দেখেও নীরব থাকতে দেখা যায়। মণিপুরে মায়ের জন্য যখন কবিতার জন্ম হয়, তখন কামদুনি-সন্দেশখালির জন্য একটা শব্দও আসে না। কবিতার এই নীরব-সরব রাজনীতিতে মানুষ আস্থা হারাচ্ছেন।

প্রবন্ধকার যে অ্যাডোনিসের কথা বলেছেন, তাঁর কবিতায় ছিল স্বাধীনতা। আজ বাংলাতে মুক্তচিন্তা কোথায়? অ্যাডোনিস ঐতিহ্য রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। এখানে রাজনীতিতে অন্ধ হয়ে তা ধ্বংস করছি। শুধু কফি হাউস আর ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনে কবিতার ঝড় উঠলে কিছু লাভ নেই। কবিতাকে নিয়ে যেতে হবে প্রান্তিক মানুষের পাশে, তাঁদের অভাব অনটনের বন্ধু হিসাবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও কবিরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। শাহ আবদুল করিম লিখেছিলেন, “ভক্তের অধীনে হও চিরদিন, থাকো ভক্তের অন্তরে।” মানুষ কাঁদছে, আর মানুষকে বাদ দিয়েই কবিতা আর রাজনীতির উৎসব চলছে চার দিকে।

তন্ময় কবিরাজ, রসুলপুর, পূর্ব বর্ধমান

অস্বাস্থ্যকর

নিউ গড়িয়া রেল স্টেশনের সাবওয়েটি অতিশয় নোংরা। চার দিকে দুর্গন্ধ। নিকাশি নালার জল দেওয়াল থেকে সাবওয়ের মধ্যে নামছে। সাবওয়েটি প্রতি দিন পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা করা হোক।

অমিতাভ বসু, কলকাতা-৮৪

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

gaza Poet Poem
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE