Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Vladimir Lenin

সম্পাদক সমীপেষু: এক উৎপীড়ক

নিজের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের শেষ কয়েক মাসে লেনিন একাধিক বিষয়ে স্তালিনের সঙ্গে বাদানুবাদে লিপ্ত হয়েছেন।

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০২০ ০০:৩০
Share: Save:

‘কী করিতে হইবে’ (২৬-৪) সম্পাদকীয়ের প্রেক্ষিতে সমাজতন্ত্র ও লেনিন-স্তালিনের পক্ষে অনেকগুলি চিঠি প্রকাশিত হয়েছে (৩-৫)। ‘জননায়ক স্তালিন’ চিঠিতে লেখা হয়েছে, লেনিন নাকি স্তালিনের রাজনৈতিক অবস্থান, মতাদর্শ ও বিপ্লবের প্রতি আনুগত্য নিয়ে কোনও বিরূপ মন্তব্য করেননি। ১৯২৩ সালের ৪ জানুয়ারি লেখা তাঁর নিজের ১৯২২-এর ডিসেম্বরের চিঠির সংযোজনীতে স্তালিনকে শুধুমাত্র রূঢ় বলেই লেনিন ক্ষান্ত হননি। আরও বলেন, “সেই জন্য আমি কমরেডদের কাছে প্রস্তাব করছি এ পদ থেকে স্তালিনকে সরাবার একটা উপায়ের কথা ভাবুন ও অন্য এমন এক জনকে সে পদে নিয়োগ করুন, সমস্ত ব্যাপারে কমরেড স্তালিনের চেয়ে যার শুধু একটা গুণ বেশি— যথা, বেশি সহনশীল, বেশি অনুগত, বেশি ভদ্র, কমরেডদের প্রতি বেশি মনোযোগী, কম খামখেয়ালি ইত্যাদি।” স্পষ্টতই, দলের ও অন্যান্য কমরেডদের প্রতি স্তালিনের আনুগত্য লেনিনের কাছে প্রশ্নাতীত ছিল না।

নিজের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের শেষ কয়েক মাসে লেনিন একাধিক বিষয়ে স্তালিনের সঙ্গে বাদানুবাদে লিপ্ত হয়েছেন। বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একচেটিয়া অধিকার রক্ষা, রাশিয়ার সমস্ত জাতিসত্তাগুলির সমানাধিকারের ভিত্তিতে সোভিয়েট ইউনিয়ন গঠন ইত্যাদি প্রশ্নে স্তালিনের সঙ্গে লেনিনের বিরোধ হয়। সোভিয়েট ইউনিয়ন গঠনের ক্ষেত্রে অন্যান্য জাতিগুলির ওপরে স্তালিন বড়-রুশী আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিলেন, সেই পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ ডিসেম্বর ১৯২২-এর এক নোটে লেনিন স্তালিনকে (এক ‘জর্জিয়ান’ বলে উল্লেখ করে) এক খাঁটি জাতীয়তাবাদী-সমাজতন্ত্রী ও এক জন ইতর বড়-রুশী উৎপীড়ক বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন এ ক্ষেত্রে প্রলেতারীয় শ্রেণি-সংহতির স্বার্থ স্তালিন দ্বারা লঙ্ঘিত হচ্ছে।

‘বুঝতে হবে’ চিঠিতে লেখা হয়েছে, স্তালিন এই চিঠিকে চেপে দেননি এবং ত্রয়োদশ কংগ্রেসে এই নিয়ে আলোচনা হয়। তাই? বাস্তব হল: ২২ মে ১৯২৪ কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিঙে ক্রুপস্কায়া আসন্ন ত্রয়োদশ কংগ্রেসে সকল প্রতিনিধির সামনে এটি পাঠ করার প্রস্তাব দিলেও, স্তালিন, জ়িনোভিয়েভ ও কামেনেভের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এ প্রস্তাব খারিজ করে দেয়। সিদ্ধান্ত হয়, প্রতিটি আঞ্চলিক প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বকে চিঠিটি আলাদা ভাবে পড়ে শোনানো হবে। কিন্তু কোনও প্রতিনিধি এই বিষয়ে নোট রাখতে পারবেন না এবং কংগ্রেসের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে লেনিনের চিঠি পাঠ করা হবে না। পার্টির বিরোধী পক্ষের চাপে লেনিনের চিঠির অংশবিশেষ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে পার্টির পঞ্চদশ কংগ্রেসের একটি বুলেটিনে (স্তালিনকে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অপসারণ করার প্রস্তাবটি ছাপা হয়নি)। লেনিনের সম্পূর্ণ চিঠিটি রাশিয়াতে প্রথম প্রকাশিত হয় স্তালিনের মৃত্যুর পরে ১৯৫৬ সালে।

স্তালিন আমলে রাশিয়ায় যে সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, সেটা মার্ক্স-লেনিনের সমাজতন্ত্র নয়, নিছকই একটা রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও স্তালিনকে স্বৈরাচারী না বললে, ঘোড়াতেও হাসবে।

সাগ্নিক চৌধুরী

কলকাতা-৮৬

মুখোশের আড়াল

‘লেনিন বাতিল?’ (২৯-৪) চিঠিতে লেখা হয়েছে, ‘লেনিনেরই শিক্ষায় শিক্ষিত এবং তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি স্তালিন এই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্য, সারা পৃথিবীর ত্রাস ফ্যাসিস্ট শক্তি হিটলারকে পরাজিত করে মানবতাকে রক্ষা করেছিলেন।’ এ বিষয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্যও স্মর্তব্য।

১৯১৮-য় ব্রেশ-লিটভস্ক’এ (বর্তমান বেলারুশ) হিটলারের নেতৃত্বাধীন জার্মানির সঙ্গে লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিকদের শান্তিচুক্তি হয়েছিল। লেনিন এই চুক্তির প্রসঙ্গে সাফাই দিতে পরে বলেছিলেন, "We took advantage of the hostility between the two imperialisms in such a way that in the long run both lost.".আর যাই হোক এতে আদর্শবাদের বিশেষ ভূমিকা ছিল না।

আবার লেনিনের স্বাভাবিক উত্তরাধিকারী ট্রটস্কিকে কৌশলে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতাসীন হওয়া ‘সুযোগ্য উত্তরসূরি’ স্তালিন, ফ্যাসিস্ট হিটলারের সঙ্গে এক মৈত্রী চুক্তি করেন, রুশ-জার্মান অনাক্রমণ চুক্তি বা মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি। ১৯৩৯ সালের ২৩ অগস্ট মস্কোতে স্তালিনের উপস্থিতিতে সে চুক্তির সঙ্গে একটি গোপন চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয় বাল্টিক দেশগুলি সম্পর্কে, সে দেশগুলির অজ্ঞাতসারে।

এই চুক্তির বলেই হিটলারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্তালিনের রাশিয়া, যৌথ আক্রমণে ভাগাভাগি করে নেয় পোল্যান্ড। আর বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভের আগেই স্তালিনের রাশিয়া গায়ের জোরে দখল করে নেয় লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, এস্তোনিয়া। আর বেয়াড়া ফিনল্যান্ডকে শায়েস্তা করতে ১৯৩৯-এর ৩০ নভেম্বর জল ও বিমানপথে সোভিয়েট ‘মুক্তিফৌজ’ ঝাঁপিয়ে পড়ে, ছোট্ট সে দেশের সেনাবাহিনী সন্ধি করতে বাধ্য হয় প্রায় সাড়ে তিন মাস লড়াই চালানোর পর।

এর মধ্যেই, ১৯৪০-এর ১১ ফেব্রুয়ারি, জার্মানি ও রাশিয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক চুক্তির পর, ‘প্রাভদা’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, এই চুক্তি অনুযায়ী শিল্পোন্নত সোভিয়েট, কাঁচামাল সরবরাহ করতেই পারে শিল্পোন্নত জার্মানির অর্থনীতি, রাজনীতি রক্ষায়। এতে আর দোষের কী! এ ভাবে দু’টি রাষ্ট্রই বোঝাপড়া করে নিজেদের মতলব হাসিল করে চলছিল, মুখোশের আড়ালে সাম্রাজ্যবাদী লোলুপতা গোপন করে, ইউরোপের ছোট ছোট দেশগুলির উপর আধিপত্য বিস্তার করে।

তাল কাটল অক্ষশক্তির চতুর্থ সদস্য হতে রাশিয়ার দাবিকৃত উচ্চমূল্য দিতে নারাজ হিটলার ১৯৪১ সালের ২১ জুন হঠাৎ সোভিয়েট রাশিয়া আক্রমণ করে বসায়। তখন রাশিয়ার স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ায় তাদের প্রথম বোধোদয় হল, হিটলারের জার্মানি কত খারাপ— হিটলার তখন ‘সারা পৃথিবীর ত্রাস ফ্যাসিস্ট শক্তি’।

স্তালিনের প্রচেষ্টা ছিল, অন্য রাষ্ট্রের উপর দাদাগিরি করে নিজের তাঁবে রাখা। স্তালিনের মত ছিল, রাশিয়ার স্বার্থে অন্য যে কোনও দেশের মুক্তিকামী নিপীড়িত জনসাধারণের আকাঙ্ক্ষা বলি দেওয়া যেতেই পারে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি এর ভুক্তভোগী।

হিরোশিমা-নাগাসাকিতে আমেরিকা পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করার পর, সবাই যখন স্তম্ভিত, সারা বিশ্ব বিস্ময় ও বেদনায় লক্ষ করেছিল, মিত্রশক্তির আর এক দোসর স্তালিনের সমাজতান্ত্রিক রাশিয়াও সুযোগ বুঝে অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল মৃতপ্রায় জাপানের উপর।

ইতিহাস এও বলে, ১৯৪৫-এর ফেব্রুয়ারিতে, ইয়াল্টা সম্মেলনে রুজ়ভেল্ট-চার্চিলের সঙ্গে স্তালিনও দুনিয়াটা ভাগ-বাঁটোয়ারা করার সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিলেন।

স্তালিন ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। কিন্তু এখনও তাঁর কর্মপদ্ধতি ও ‘কীর্তি’র নেতিবাচক দিকটির যথার্থ মূল্যায়নের বদলে, অন্ধ রাজনৈতিক বিশ্বাসে ব্যক্তিপূজা চলবে?

শান্তনু রায়

কলকাতা-৪৭

সন্ত্রাস

লেনিন নিজে এক লাখ কুলাককে যমালয়ে পাঠিয়েছিলেন এবং বলতেন, আমরা যদি সন্ত্রাস ব্যবহার না করি, তবে আমরাই লোপাট হয়ে যাব। আর স্তালিন, বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার জন্যে, তিনটে ‘মস্কো ট্রায়াল’ করে বিচারের নামে প্রহসন করে, বছরের পর বছর গণহত্যা চালিয়ে গিয়েছেন। ওই সময় রাশিয়ার চার কোটি তিরিশ লক্ষ দেশবাসী খুন হয়েছেন কিংবা নিরুদ্দিষ্ট হয়েছেন অথবা সাইবেরিয়াতে পচে মরেছেন।

১৯৯২ সালে জন পিলজারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নোম চমস্কি বলেছিলেন, "I was also anti Leninist, because Stalinist crimes had their origin in Leninist authoritarianism."

পার্থ হাজারি

কলকাতা-৬

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,

কলকাতা-৭০০০০১।

ইমেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE