হ্যামলিনের বাঁশি একটু মনে হয় বেসুরে বাজছে। সভার পর সভা হয়ে চলেছে, ভিড় নেই, তিনি পরদার আড়ালে অপেক্ষা করছেন কখন একটু ভিড় জমে— মাঝেমাঝেই ফোন আসছে চেয়ার কমাতে হবে, যাতে ভিড়ের একটা ছবি অন্তত তৈরি করা যায় তাঁর বিখ্যাত সোশ্যাল মিডিয়া বাহিনীর জন্য। জুয়ার বাজারে জোর উত্তেজনা, কবে একটু খিমচে চোখের জল ফেলবেন তিনি, ভোট টানতে যা হতেই পারে তুরুপের তাস। চায়ের কেটলি থেকে সিংহাসন— এই কাহিনিতেও চিঁড়ে যদি আর না ভেজে, তা হলে ক-ফোঁটা চোখের জল ফেলেছ যে তুমি...
অন্য দিকে তিন সম্প্রদায়ের তিন তরুণ তুরকি নেতা এসে পড়েছেন কংগ্রেসের ছাতার নীচে । সভায় সভায় ভাল ভিড়, যদিও সেখানেও রাজনীতির মূল সুর পশ্চাদ্গামী— সংরক্ষণ ও জাতপাতের আবর্তে একটা সমীকরণ তৈরির প্রয়াস। কিন্তু মানুষ যে শুনছে, তার ছবি স্পষ্ট। এমনকী জাতীয় খোরাক হিসেবে যিনি নিজের নাম খোদাই করে ফেলেছেন, সেই রাজকুমারের সভা বা পদযাত্রায় উপচে পড়া ভিড়। ‘হার্দিক-অল্পেশ-জিগ্নেশ’, এই তিনমূর্তির কায়দা করে একটা নামকরণও হয়েছে, ‘হজ’— যাতে মেরুকরণের একটা সুযোগ তৈরি হয়।
হলটা কী গুজরাতে? মাস চারেক আগেও তো এ রাজ্যে শাসক দলের সহজতম জয় সকলেরই অনিবার্য মনে হচ্ছিল। স্বয়ং হ্যামলিন সেখানকার ভূমিপুত্র, গত এক দশকে এমন নাকি তার বিকাশের মডেল, যা ভারতের কাছে শিক্ষাস্বরূপ। এক একটা ‘ভাইব্রান্ট গুজরাত’-এ এমন অঙ্কের মউ সই হয়, যাতে শূন্যের পরিমাণ খালি চোখে হিসেব করা দুষ্কর। উন্নয়নের সেই ‘ভাইব্রেশন’ তা হলে কী করে একটা রাজনৈতিক ভূকম্পনের চেহারা নিচ্ছে? অহমেদ পটেলের রাজ্যসভার ভোট দিয়েই কি এর সলতে পাকানো শুরু?
দু’বছর আগে, পাতিদার আন্দোলন যখন দানা বাঁধে, তখন আমি এই পাতায় গুজরাতের সার্বিক প্রগতির ক্ষেত্রে সমস্যার জায়গাগুলো আলোচনা করেছিলাম। যে রাজ্যে গত এক দশকে ষাট হাজার ছোট শিল্প বন্ধ হয়েছে, ব্যাংকিং পরিষেবায় ১৮তম, উচ্চ শিক্ষায় ভর্তির হারে ১৩তম, শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরিতে দীর্ঘদিন ধরে তলানিতে থেকেছে, নারী-পুরুষের অনুপাতে ২৪তম, অপুষ্টি-শিশুমৃত্যু-নারীর স্বাস্থ্য সব কিছুতেই জাতীয় গড় থেকে নীচে, দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষের অনুপাত বাড়তে থেকেছে গত এক দশকে, তাকে শুধু জিডিপি বৃদ্ধির হার আর চকচকে রাস্তা দেখিয়ে উন্নয়নের মডেল বলা বাতুলতামাত্র। বরং তাতে সমস্যাটা আরও গভীর হয়, সমাজের মধ্যে বৈষম্যটা আরও বাড়তে থাকে। শুধু স্লোগান দিয়ে আর সোশ্যাল মিডিয়ার দুন্দুভি বাজিয়ে প্রদীপের নীচে এই অন্ধকারকে বেশি দিন ঢেকে রাখা যাবে না।
তার সঙ্গে আছে জাতীয় স্তরের জ্বলন্ত সমস্যাগুলো। একে তো বিমুদ্রাকরণ আর জিএসটি-র যুগলবন্দিতে দেশ জুড়ে ছোট-মাঝারি শিল্প আর গ্রামীণ অর্থনীতিতে নাভিশ্বাস উঠেছে। তারই প্রভাবে সুরাত আর তার বস্ত্রশিল্প এক অভূতপূর্ব সংকটের মুখোমুখি। সারা দেশে জিডিপি বৃদ্ধির হার মুখ থুবড়ে পড়েছে। নতুন কাজ তৈরি তো হচ্ছেই না, যা ছিল তাও ধুঁকছে দেশকে ক্যাশলেস করে ফেলার এক মরণখেলার অভিঘাতে। কৃষিক্ষেত্রে তো পরিস্থিতি শোচনীয়, আত্মহত্যার মিছিল চলছে, কোনও বিকল্প তৈরি না করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে রক্তশূন্য করে ফেলায় চাষি তাঁর ফসলের দাম পাচ্ছেন না। এ সব কিছুর প্রভাব গুজরাতের জনমানসে কিছুটা হলেও পড়বেই। বুলেট ট্রেনের স্বপ্ন দেখানো, ঠেলায় পড়ে কিছু পণ্যে জিএসটি-র হার কমানো, আর পদ্মাবতীর জিগির তোলা ছাড়া হাতে অস্ত্র কি আর বিশেষ কিছু আছে ?
গত দু’তিন মাসে তাই অনেক হিসেব ওলটপালট হয়ে গেছে, হাওয়ামোরগের ঝুঁটি একটু গোলমেলে আচরণ করছে। কংগ্রেস দলের সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচার গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, আর তার সঙ্গে এই তিন তরুণ নেতার তালমিল সমাজের অনেক অংশকে একটা ছাতার তলায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাই দেশের রাজ্যপাট রইল শিকেয়, শাসক দলের বড়-মেজ সব কেন্দ্রীয় নেতাই এখন গুজরাতের মাটি কামড়ে। আপাতনিরীহ একটা নির্বাচন এখন তাই সেয়ানে-সেয়ানে।
কিন্তু গণেশ কি তাতে ওলটাবে? সে প্রশ্নের উত্তর পেতে ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ অবধি অপেক্ষা। মানুষের মনের চিন্তার প্রতিফলন ভোটবাক্সে প্রতিফলিত হওয়ার পথটা সহজ নয়, বুথভিত্তিক ভোট কুড়নোর অনেক অঙ্ক থাকে তার মধ্যে। সেখানে কাডারভিত্তিক দল হিসেবে শাসক দল কিছুটা হলেও এগিয়ে। তাই শেষ পর্যন্ত পাটিগণিতের হিসেবে মসনদ টিকে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কিন্তু বিজেপির আসল ভয় তো শুধু অক্সিজেন পাওয়া কংগ্রেস নয়, বিজেপি নিজেও। গত বারের থেকে আসন কমলেই অনেক নখ-দাঁত বের হবে, একনায়কতন্ত্রের দাপটে যা আপাতত বাধ্য হয়ে লুকিয়ে রেখেছে অনেকে। ২০১৯-এর পথ তাই তত সুখের না হতেও পারে।
অধিকর্তা, ইনকিউব গ্রুপ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy