Advertisement
০৩ মে ২০২৪
laxmi puja

শ্রীময়ী

লক্ষ্মীকে ঠাঁই দেওয়ার পদ্মটি শুধুমাত্র অন্তরেই বিকশিত হয়। ক্লেদহীন, নিষ্কলুষ অন্তর, যেখানে অপরকেও ঠাঁই দিতে দ্বিধা হয় না।

লক্ষ্মীপুজো।

লক্ষ্মীপুজো।

শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২২ ০৫:৫০
Share: Save:

ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ছাড়াও বাঙালির জনসংস্কৃতিতে আর এক সূক্ষাতিসূক্ষ্ম, স‌ংগুপ্ত বিভাজন আজ, কোজাগরীর রাতে। এ-দিন মূলত পূর্ববঙ্গীয়দের লক্ষ্মীপুজো। এ-দেশীয় অর্থাৎ আদি অর্থে পশ্চিমবঙ্গীয়দের আজ নয়, কালীপুজোর রাতে দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো। সেটিকে অনেক সময় অলক্ষ্মী বিদায়ও বলা হয়। লক্ষ্মী যেমন ধনসম্পদের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, তাঁর বড়দি এই অলক্ষ্মী সে রকম দুর্ভাগ্যের। অলক্ষ্মী অতি কুৎসিত এবং ঘোর কালো, গায়ে লোহার গয়না, হাতে ঝাঁটা। গাধা তাঁর বাহন। ব্রতকথার গল্প, সমুদ্র থেকে লক্ষ্মীর আগে অলক্ষ্মী উঠেছিলেন। কিন্তু দেবতারা কেউ তাঁকে গ্রহণ করলেন না। ভগবান বিষ্ণু চিন্তিত, অবশেষে তিনি উদ্দালক ঋষির সঙ্গে অলক্ষ্মীর বিয়ে দিলেন। ঋষি স্ত্রীকে নিয়ে আশ্রমে চলে গেলেন। কিন্তু আশ্রমের শান্ত পরিবেশ ও নির্জনতা অলক্ষ্মীর পছন্দ হল না। শেষ পর্যন্ত ছোট বোনের দয়া হল, তিনি স্বামী নারায়ণকে উপায় ঠাওরাতে বললেন। নারায়ণ বড় শ্যালিকাকে অশ্বত্থ গাছে উঠিয়ে দিলেন, সেই থেকে অলক্ষ্মীর নিবাস অশ্বত্থ গাছ। এক বোন ফর্সা, অন্য জন কালো, এক জন মুখরা, অন্য জন শান্ত— এ সবের মধ্যে হাল আমলের রাজনৈতিক ঠিক-বেঠিক অঙ্ক খুঁজলে ভুল হবে। ব্রতকথার গল্পগুলি এই রকম। সেখানে লক্ষ্মী-অলক্ষ্মী দুই বোন পাশাপাশি থাকেন। বড়দি ঝগড়াটে হলেও ছোট বোন তাঁকে ছেড়ে যান না। বরং স্বামীকে বলে তাঁকে নতুন আশ্রয়ের সন্ধান দেন। বেদ-পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারত অনেক হল, সমুদ্রমন্থনের ধনসম্পদ, ঐরাবত, অমৃত নিয়ে লক্ষ্মীও উঠে এলেন, আজ অন্তত দেশজ ব্রতকথার দিকে বাঙালির দৃষ্টি পড়ুক!

ধর্মবিশ্বাসের প্রয়োজন নেই, পুজোআচ্চারও নয়। লক্ষ্মীর কাহিনিকে আসলে বঙ্গজীবনের আখ্যান হিসাবেই পাঠ করা যায়। সংসারে কোণঠাসা অবন্তী রাজ্যের রানিকে নারদ উপদেশ দেন, ‘লক্ষ্মীবারে সন্ধ্যাকালে যত নারীগণ। পূজিবে লক্ষ্মীরে হয়ে একমন॥’ সেই পূজায় আয়োজনের বাহুল্য নেই, এমনকি পুজোয় যে মূর্তি থাকতেই হবে, সেই বিধানও নেই। পটের ছবি, সরা, ঘট, কড়ি, সিঁদুরের কৌটো, পেঁচার মূর্তি থাকলেও হবে। দেবী চঞ্চলা হতে পারেন, কিন্তু তিনি অন্তঃপুরিকাদের এই সামান্য উপকরণেই তুষ্ট। কড়ি পরে বিনিময়ের মুদ্রা, কিন্তু তার জন্ম তো লক্ষ্মী যেখান থেকে উঠে আসেন, সেই সমুদ্রের অতলেই। ইঁদুর রাতের বেলায় মাঠে ধান খেয়ে শেষ করে দেয়, নিশাচর পেঁচা সেই দুর্ভাগ্যের হাত থেকে গৃহস্থকে বাঁচায়। এ দিন ঘরদোর সাফসুতরো রাখতেই হবে। ব্রতকথার গল্পে এক সওদাগরের লক্ষ্মীরূপিণী স্ত্রীর মৃত্যুর পর ছেলের বৌরা সারাক্ষণ আলস্য, ঝগড়াঝাঁটিতে দিন কাটায়। তখন অলক্ষ্মীদেবী সওদাগরের দ্বিতীয় পত্নী হয়ে সেই সংসারে ঢোকার চেষ্টা করেন। কিন্তু ছোট ছেলের বৌয়ের সদাচরণে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অলক্ষ্মী সংসারে যেন তেন প্রকারেণ ঢোকার চেষ্টা করবেন, কিন্তু পুত্রবধূর কল্যাণে সেই চেষ্টা বানচাল হবে— সান্ধ্য সিরিয়ালের গন্ধ পাওয়া বিচিত্র নয়।

ধর্ম বলতে বাঙালি এই দৈনন্দিনতাকেই বুঝেছে এত কাল— এই বাংলার মাটিতে দেবতা চিরকালই প্রিয় হয়েছেন। বাঙালির ধর্মে তরবারির ঝনঝনানি নেই, আকাশ কাঁপিয়ে হুঙ্কার নেই— যা আছে, তা এক নিরবচ্ছিন্ন শান্তশ্রী। আজকের লক্ষ্মীপুজো আসলে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। ভক্তের বিশ্বাস যে, এই রাতে লক্ষ্মী বরদাত্রী হয়ে মর্তধামে দেখতে আসেন, কে জেগে রয়েছে। এই রাতে লক্ষ্মীলাভে সচেষ্ট ব্যক্তিরা তাই জেগে থাকেন, চিঁড়ে এবং নারকেলের জল পান করে সারা রাত পাশা খেলেন। কোনও কৃচ্ছ্রসাধন বা হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ হয়ে দিনের পর দিন কঠোর তপস্যা নয়, লক্ষ্মী তাঁর ইচ্ছামাফিক এই জাগ্রত ব্যক্তিদের কাউকে বিত্তলাভের বর দেবেন। ভেবে দেখলে, প্রাত্যহিকতায় অবিচল থাকতে পারাই আসলে বাঙালির লক্ষ্মী-সাধনার মূল কথা— বাড়িঘর পরিষ্কার রেখে, প্রিয়জন ও আতুরের জন্য অন্নের সংস্থান করে শুধু লক্ষ্মীর প্রতীক্ষা করলেই দেবী সন্তুষ্ট। মর্ত-কাছে স্বর্গ যা চায়, তা সম্ভবত এই নিরহঙ্কার স্বাভাবিকতা। লক্ষ্মীর পাঁচালির শুরুতেই নারায়ণ চিন্তিত, কলিতে পাপে পূর্ণ ধরা। ‘যাগ-যজ্ঞ ক্রিয়া অবহেলা করে সবে।’ তখন লক্ষ্মী বলেন, ‘ভয় নাই, সমাধান সত্বর করিব। লক্ষ্মীছাড়া নরলোক আমি উদ্ধারিব॥’ কী ভাবে, সেই পদ্ধতি পাঁচালিতে বর্ণিত আছে। আজকের দিনটিতে অন্তত বাঙালি স্মরণে রাখতে পারে যে, লক্ষ্মীকে ঠাঁই দেওয়ার পদ্মটি শুধুমাত্র অন্তরেই বিকশিত হয়। ক্লেদহীন, নিষ্কলুষ অন্তর, যেখানে অপরকেও ঠাঁই দিতে দ্বিধা হয় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

laxmi puja Bengali Culture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE