Advertisement
১৮ মে ২০২৪
G20 summit

বিশ্বগুরু কথা

জি২০’র দেশগুলির নিরিখে ভারত কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, সে তুলনা করে দেখাও সাধারণ মানুষের পক্ষে কঠিন, নেতারা বিলক্ষণ জানেন।

G20

— ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:১৬
Share: Save:

দেশের একশো চল্লিশ কোটি মানুষের মধ্যে ক’জনই বা জানেন, জি২০ বস্তুটি খায় না মাথায় দেয়? যাঁদের সে বিষয়ে কিঞ্চিৎ ধারণা আছে, তাঁদের মধ্যেই বা কত জন জানেন যে, ১৯টি দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই জোটের সভাপতিত্ব ঘুরে-ফিরে সব দেশের কাছেই আসে, তার জন্য কোনও বিশেষ কৃতিত্বের প্রয়োজন হয় না? অনুমান করা চলে যে, খুব বেশি মানুষ এত শত কথা জানেন না— জানার কোনও কারণও নেই, এর চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে মনে রাখার জন্য। মুশকিল হল, দেশের নেতারা জানেন, মানুষের এই অজ্ঞানতাকে কী ভাবে নিজেদের রাজনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে হয়। ভারতের জি২০ সভাপতিত্ব করার কথা ছিল ২০২১-২২ সালে— দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছরের সঙ্গে তাকে মেলাতে হবে, এমন একটি অজুহাতে ২০১৮ সালে বুয়েনোস আইরেসে জি২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইটালির সঙ্গে সভাপতিত্বের বছরটি অদলবদল করে নেন। দুর্জনে অবশ্য বলবে যে, স্বাধীনতার ৭৫ বছর অজুহাতমাত্র, মাছের চোখটি ছিল ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচন। অস্বীকার করা যাবে না, সেই উদ্দেশ্যে জি২০’র ব্যবহারটি মোক্ষম হয়েছে। গোটা দেশ ছেয়ে গিয়েছে পোস্টারে, দিল্লির সব ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণ উজ্জ্বল হয়েছে জি২০’র আলোকছটায়। নরেন্দ্র মোদী ভারতকে ‘বিশ্বগুরু’ বলেছেন, আর তাঁর ভক্তকুল সেই তকমা দিয়েছেন তাঁকে। মোটমাট, দেশবাসী বিস্ফারিত চোখে দেখলেন, কিছু একটা হল বটে! খানিক গণমাধ্যমে, খানিক সমাজমাধ্যমে আর খানিক এর-ওর মুখেও শুনলেন, প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য নেতৃত্বে ভারত জগৎসভার শ্রেষ্ঠ আসনটিতে গ্যাঁট হয়ে বসে পড়েছে। সে বিশ্বজয় যে নিতান্তই বিশ্বগুরুর কৃপা, বিশ্বাস না করে মানুষের আর উপায় কী!

জি২০’র দেশগুলির নিরিখে ভারত কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, সে তুলনা করে দেখাও সাধারণ মানুষের পক্ষে কঠিন, নেতারা বিলক্ষণ জানেন। ফলে, তাঁরা জানেন, তাঁরা যা রটনা করবেন, তা-ই সত্য। বেশি জটিল হিসাবের প্রয়োজন নেই, কয়েকটি সাদামাঠা অঙ্ক লক্ষ করলেই তাঁদের রচিত আখ্যানটির মিথ্যা ধরা পড়বে। জি২০’র কুড়িটি দেশের মধ্যে মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ভারত সর্বনিম্ন; তার ঠিক আগের চারটি স্থানে আছে যথাক্রমে ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজ়িল ও রাশিয়া— যে দেশগুলির মাথাপিছু আয় যথাক্রমে ভারতের দ্বিগুণ, তিন গুণ, সাড়ে চার গুণ ও পাঁচ গুণ। মানবোন্নয়ন সূচকের নিরিখে ভারত ২০টি দেশের মধ্যে ২০তম স্থানে; শিশুমৃত্যুর হারে অবস্থা সামান্য ভাল, ভারত ১৯তম স্থানে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভারত গোটা দুনিয়াকে গণতন্ত্রের পাঠ দিচ্ছে। ফ্রিডম হাউস ইন্ডেক্স ভারতীয় গণতন্ত্রকে ‘আংশিক ভাবে মুক্ত’ তকমা দিয়েছে। ‘শ্রেষ্ঠত্ব’-এর এমন উদাহরণের তালিকা দীর্ঘায়িত করার প্রয়োজন নেই— কিন্তু, এই কথাগুলি কোনও ভাবেই সাধারণ মানুষের কানে পৌঁছবে না, নেতাদের এ-হেন বিশ্বাসটি ভাঙা অতি জরুরি।

অবশ্য তাঁরা বলতে পারেন, এ সবই পূর্বসূরিদের কর্মফল— পূর্বতন সরকারগুলি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট সচেষ্ট হয়নি, তাই ভারত এমন পিছিয়ে আছে। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন করা যায়, যে বছর দেশ বিশ্বের সবচেয়ে বড় কুড়িটি অর্থব্যবস্থার জোটের সভাপতি হল, সে বছরই দেশে বিদেশি বিনিয়োগের এমন খরা কেন? রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষের প্রথম ছ’মাসে ভারতে যত কম প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, ২০০৭-০৮ সালের পর কখনও তত কম হয়নি। জিডিপি-র অনুপাতে এই বিনিয়োগের পরিমাণও ২০০৫-০৬ সালের পর সর্বনিম্ন। লগ্নি কেন কম, তার একাধিক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হল, ‘বিশ্বগুরু’ গোত্রের আপনি-মোড়ল অবস্থানকে বিশ্ব বাজার পাত্তা দেয় না। ওতে ঘরোয়া রাজনীতির চিঁড়ে যদি বা ভেজে, আন্তর্জাতিক মর্যাদা ভিন্ন সাধনার ফল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

G20 summit PM Narendra Modi BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE