Advertisement
০৫ মে ২০২৪
polymorphic

বহুরূপীধর্ম

কেবল দল সময়মতো বদল করিলেই হইবে না, সেই সময়ের দলের স্বার্থ সাধন করিতে মুহূর্তের জন্য অন্য দলের গর্ভগৃহে সেই দলের ছদ্মবেশে ঢুকিয়া পড়া চাই।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২১ ০৪:৪৯
Share: Save:

পুরাতন ভারতের দেব-দেবীগণ বহুরূপ ধারণ করিতে পারিতেন। তাঁহারা ‘বহুরূপা’ বিদ্যার অধিকারী ছিলেন বলিয়া সুকৌশলে কার্য সিদ্ধ করিতেন। অমৃতভাণ্ড উঠিয়াছে। দেবাসুরের মন্থনলব্ধ এই অমৃতভাণ্ড অসুরদের হস্তে পতিত হউক, তাহা দেবতাগণ চাহেন না। অতঃপর বিষ্ণু মোহিনীরূপ ধারণ করিয়া পরমভাণ্ডটি অসুরদের নিকট হইতে হরণ করিলেন। বাংলা রামায়ণে রাবণের রাজসভায় অঙ্গদ উপস্থিত হইল। দূত অঙ্গদকে, রাবণ তাঁহার সভায় বসিতে অবধি বলেন নাই। বালিপুত্র লেজ বাগাইয়া, সিংহাসন বানাইয়া লাঙ্গুলারূঢ় হইলেন। তৎক্ষণাৎ রাবণে-অঙ্গদে তুমুল তর্ক-বিতর্ক লাগিয়া গেল। তরজাকালে অঙ্গদকে বোকা বানাইবার জন্য রাবণের পাত্র-মিত্র সবাই সহসা রাবণরূপ ধারণ করিলেন। কেবল ইন্দ্রজিৎ স্ববেশে— পুত্র হইয়া পিতার মায়া-দেহরূপ কেমন করিয়াই বা ধারণ করিবেন। পিতাকে অসম্মান করা হইবে যে! অঙ্গদও কম যান না, কিষ্কিন্ধ্যা-কালচারের মহতী বুলি বঙ্গজ বানরোত্তমের কণ্ঠলগ্ন। সুযোগ পাইবা মাত্র রাবণপুত্র ইন্দ্রজিৎকে দিব্য দুই-কথা শুনাইয়া দিলেন। ‘ধন্য নারী মন্দোদরী/ ধন্য রে তোর মাকে/ এক যুবতী/ এত পতি/ বল কেমনে রাখে।’ বেচারা ইন্দ্রজিৎ! মাথা নত করিয়া শুনিলেন। কথার দাপটে পাত্র-মিত্র সকলে শেষে রাবণের ছদ্মবেশ ত্যাগ করিয়া স্বরূপে ফিরিলেন।

বহুরূপ ধারণ করিবার মহাকাব্যিক ও পৌরাণিক সামর্থ্য ক্রমে নিতান্ত সাধারণের জীবিকা হইয়া দাঁড়াইল। বেচারা বহুরূপী নিজের উপর অপরের রূপ আরোপ করিয়া ভয় দেখাইয়া, মনোরঞ্জন করিয়া দুই-পয়সা উপার্জন করিতে তৎপর। তাহাতেই পেট ভরে। দরিদ্র বহুরূপী তাঁহার নট-পেটিকা লইয়া পথে পথে ঘুরিতেছেন। বৃক্ষতলে বসিয়া সাজিতেছেন। তাহার পর গ্রামের দুয়ারে দুয়ারে উপস্থিত। যদি সজ্জাকৌশল দেখিয়া কেহ ভিক্ষা দেন, তবে তাঁহার পেট চলে। কখনও কালী-দুর্গা-শিব, কখনও বা বন্য পশু। অবশ্য মধ্যে মধ্যে ‘মিস-ফায়ার’ হইয়া যাইত। সেক্ষণে ভিক্ষা তো জুটিতই না, বরং লেজ কাটা পড়িত। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের শ্রীনাথ বহুরূপীর কপাল সত্যই বড় মন্দ। বাঘবেশ ধারণ করিয়া সে যাও বা ‘ভয়’ দেখাইতে সমর্থ হইয়াছিল তথাপি তাহার শেষ রক্ষা হইল না, অর্থোপার্জনও নহে! বাঘ নহে শ্রীনাথ, এই সত্য প্রকাশিত হইতেই ভীতি-কম্পিত গৃহকর্তা স্ববশে আসিলেন। নকল ব্যাঘ্রকে আসল ভাবিয়া তিনি ভয়ে কম্পমান হইয়া বন্দুক লইয়া আসিতে বলিতেছিলেন। বন্দুক আসিলে কী হইত বলা কঠিন! বন্দুক আসিল না বটে, তথাপি যেই ক্ষণে শ্রীনাথের স্বরূপ উন্মোচিত হইল, সেই ক্ষণে নিজের ভয়-পাইবার ঘটনা ঢাকিতে গৃহস্বামী বহুরূপীর লাঙ্গুল কর্তনের আদেশ দিলেন। বেচারা শ্রীনাথ নিতান্ত শ্রীহারা ছিনাথে রূপান্তরিত হইল।

একালের বহুরূপীরা এক অর্থে সকলেই ‘বেচারা’ ছিনাথ। কেহ প্রত্যক্ষ জীবিকায় বহুরূপী, কেহ পরোক্ষ জীবিকায় বহুরূপী। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকে গোসাঁইয়ের ছিল দুই রূপ। গোসাঁই সাজিয়া ধর্মের বুলি যেমন তিনি বিলাইয়া থাকেন, তেমন সর্দার হইয়া প্রশাসন চালাইয়া থাকেন। কোনটি আসল কোনটি ছদ্মবেশ— বলা মুশকিল। দুই মিলিয়াই তাঁহার পেট চলে। পেট বড় বালাই। প্রয়োজনের ধর্মই হইল তাহা নিত্য বর্ধমান। আজ যাহা এইমাত্র, সুযোগ পাইলেই তাহা বহুমাত্র হইয়া উঠে। কাজেই উদর নামক বৃহৎ গহ্বর ভরাইতে ঘন ঘন বহুরূপীর ন্যায় সজ্জা বদল করিতে হয়। যখন যে সজ্জার রমরমা এ-কালের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মী-গণ সেই সজ্জা ধারণ করিয়া থাকেন। ইহাতে দোষের কিছু আছে কী? তাঁহারা বলিবেন শরীরটিকে রসে রাখিতে হইবে, বাঁচিতে হইবে, তাই যখন যেমন তখন তেমন বশ্যতা স্বীকার করা চাই। বশ্যতা অনুযায়ী বেশ-বদল করিতে হইবে, সেই অনুযায়ী পতাকা ধারণ করিতে হইবে। রাজনৈতিক দলগুলি যেন লাভজনক কোম্পানি। যখন যাহার কাটতি বেশি, তখন তাহার পোঁ ধরা চাই। পোঁ ধরিবার জন্য নানা বেশভূষা হাতের কাছে মজুত। সুযোগমতো নিজেকে সাজাইয়া-গুছাইয়া পথে নামিতে হইবে। কেবল দল সময়মতো বদল করিলেই হইবে না, সেই সময়ের দলের স্বার্থ সাধন করিতে মুহূর্তের জন্য অন্য দলের গর্ভগৃহে সেই দলের ছদ্মবেশে ঢুকিয়া পড়া চাই। বহুরূপী বেশে খবর আনিয়া দিতে হইবে, অন্তর্ঘাত ঘটাইতে হইবে। সব মিলাইয়া নানা রাজ্যে নির্বাচন যত নিকটে আসিবে, তত বহুরূপীগণের মূল্য বৃদ্ধি পাইবে। রাজনীতির ছিনাথগণ এক্ষণে এই ভাবেই ক্রমান্বয়ে বেশ বদলাইয়া লাঙ্গুল বজায় রাখিবেন। বহুরূপীধর্ম উদর ও লাঙ্গুল বজায় রাখিবার ধর্ম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

polymorphic Political Party
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE