Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আর ক্যাম্পাসের বাইরে?

কিছু কিছু ঘটনায় হৃদয় যে ভাবে সাড়া দেয়, মস্তিষ্ক তাতে ষোলো আনা সায় দিতে পারে না, প্রশ্ন তোলে। এক নম্বর প্রশ্ন, বহিরাগত বলে আলাদা করে আপত্তি কেন?

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৭ ০৬:১০
Share: Save:

যা দবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ‘বহিরাগত’ তরুণকে নিয়ে গত সপ্তাহে পর পর দু’দিন এক পশলা করে গোলযোগ হয়ে গেল। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, দু’জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা সাম্প্রদায়িক, জাতিগত এবং প্রাদেশিক বিদ্বেষ ছড়িয়ে পরিবেশ বিষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিল। সেই নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রছাত্রী, গবেষক, শিক্ষকের সঙ্গে তাদের বিবাদ ও সংঘাত বাধে। দ্বিতীয় দিনে অশান্তি উপাচার্যের দরবারে পৌঁছয়, শেষে থানা-পুলিশ অবধি গড়ায়। উপাচার্য জানিয়ে দিয়েছেন, ‘‘বহিরাগতদের এমন কাণ্ড ক্যাম্পাসে বরদাস্ত করা হবে না। সাম্প্রদায়িকতা, প্রাদেশিকতার কোনও জায়গা যাদবপুরের ক্যাম্পাসে নেই।’’

কিছু কিছু ঘটনায় হৃদয় যে ভাবে সাড়া দেয়, মস্তিষ্ক তাতে ষোলো আনা সায় দিতে পারে না, প্রশ্ন তোলে। এক নম্বর প্রশ্ন, বহিরাগত বলে আলাদা করে আপত্তি কেন? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো যে প্রতিষ্ঠানগুলি মুক্ত চিন্তার স্বাধীনতার পক্ষে ধারাবাহিক ভাবে সওয়াল করে আসছে, এই আপত্তি কি তাদের স্বধর্মের প্রতিকূল নয়? বস্তুত, অতীতে— সুদূর নয়, অদূর অতীতে— এই বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কর্ণধার এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকদের অনাচারের বিরুদ্ধে যখন ছাত্র-শিক্ষক-গবেষকরা প্রতিবাদে উত্তাল হন, তখন সেই প্রতিবাদ দমনের যুক্তি হিসেবে কর্তৃপক্ষ খুব জোর গলায় বলেছিলেন যে, ‘বহিরাগতরা’ এসে উৎপাতে যোগ দিয়েছে, এটা অন্যায়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান কর্মকাণ্ডে অনেকে বাইরে থেকে এসে যোগ দিচ্ছে, এটা কোনও নতুন ব্যাপার নয়, আবার প্রশাসকরা সেই যুক্তিতে প্রতিবাদ বা বিক্ষোভকে হেয় করতে বা দমন করতে চাইছেন, এমনটাও পরিচিত ব্যাপার।

বহিরাগত নিয়ে আপত্তি তোলার ব্যাপারে প্রশাসনের আগ্রহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে বৃহত্তর রাজনীতিতেও অপরিচিত নয় মোটেই। সিঙ্গুরের আন্দোলনে ক্ষিপ্ত হয়ে বামফ্রন্ট সরকারের নায়করা এবং তাঁদের ভক্তবৃন্দ যখন ‘বহিরাগত’ প্রতিবাদীদের মুণ্ডপাত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তখন তাঁদের বোধহয় খেয়াল ছিল না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কলকারখানা, সর্বত্র যে সব আন্দোলন করে তাঁরা ক্ষমতায় পৌঁছেছেন, সেগুলিও মোটেই অন্তরাগতদের নিজস্ব আন্দোলন ছিল না। তাঁদের দোষ দিই না, গদিতে অনেক দিন বসে থাকলে অনেক কিছুই খেয়াল থাকে না। কিন্তু সেই কারণেই সত্যি কথাটা মনে করিয়ে দেওয়া জরুরি— শুধু বহিরাগত বলে দরজা বন্ধ করলে ধর্মে সইবে না।

জানি, এবং মানি, সব বহিরাগত সমান নয়। কে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে, সেটা খুব বড় ব্যাপার। তারা কী করছে, কোন প্রেক্ষিতে করছে, সেটাও অবশ্যই বিচার করা জরুরি। গত সপ্তাহের ঘটনাপরম্পরার পিছনে কেবল উদ্দেশ্য নয়, অভিসন্ধির ছায়াও সুগভীর। মগনলাল মেঘরাজ বলবেন, আর্ডিনারি অভিসন্ধি নয়, এক্সট্রাআর্ডিনারি অভিসন্ধি। বিদ্বেষের রাজনীতি প্রচারের যে তুমুল ও বহুমুখী অভিযান চলছে, দেশের প্রধান কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলি তার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। নানা ভাবে, নানা দিক থেকে এই রাজনীতি তাদের দখল নিতে চায়। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি এখনও সেই সর্বগ্রাসী তৎপরতার কাছে আত্মসমর্পণ করেনি, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাদের মধ্যে প্রথম সারিতে। সে জন্য এই রাজনীতির কারবারিদের মর্মদাহ অস্বাভাবিক নয়। তাঁরা নানা ভাবে এই প্রতিষ্ঠানে, আক্ষরিক অর্থেও, ঢুকে পড়ার চেষ্টা চালিয়েছেন, বাধা পেলে তুলকালাম বাধিয়েছেন, ভয়ানক গালিগালাজ এবং হুমকিও দিয়েছেন। সুতরাং বাইরে থেকে এসে কেউ অন্যায় কথা বললে বা অশোভন আচরণ করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন ছাত্র-গবেষক-শিক্ষকরা ক্রুদ্ধ হবেন, সেটা কেবল স্বাভাবিকই নয়, প্রয়োজনীয়ও বটে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্রোধ একটি মূল্যবান অস্ত্র।

কিন্তু মূল্যবান অস্ত্রের অপব্যবহার করতে নেই। কখন কোন অস্ত্র প্রয়োগ করতে হয়, সেই জ্ঞান না থাকলে সুযোদ্ধা হওয়া যায় না, সে কথা মহাভারত পড়লেই জানা যাবে। প্রতিপক্ষ যদি দল পাকিয়ে হিংস্র আক্রমণ করতে আসে তখন এক ভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু তারা দু’চার জন যদি আড্ডা বা আলোচনার মধ্যে ঢুকে পড়ে আপত্তিকর কথা বলে বা শিক্ষকের অপমান করে, তার মোকাবিলায় অন্য পথই শ্রেয়। সেটা তর্কের পথ, মতবিনিময়ের পথ, প্রয়োজনে ভর্ৎসনারও পথ। কিন্তু প্রতিপক্ষের কথা এবং আচরণ যত আপত্তিকরই হোক, তার প্রতিক্রিয়ায় আমার অন্তরের ক্রোধ যত তীব্র এবং পবিত্রই হোক, আমি তাতে বেসামাল হব না, নিজস্ব যুক্তি এবং প্রত্যয়ের দৃঢ় ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গভীরতম প্রশান্তির সঙ্গে কঠোরতম প্রতিবাদ করব— এটাই তো গণতান্ত্রিক তর্কযুদ্ধে যথার্থ অস্ত্রশিক্ষার শর্ত। প্রতিপক্ষ অন্যায় করছে বলে আমি আমার স্বধর্মে স্থিত থাকব না কেন? বস্তুত, তখনই তো আমার সত্যিকারের পরীক্ষা। অনেক সময়েই সেই পরীক্ষার উপযোগী পরিবেশ থাকে না, হিংসার আশঙ্কা থাকে, সেই হিংসা নিবারণ করতে শক্তিপ্রয়োগের দরকার হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিসরে দুই তরুণের মোকাবিলায় তেমন আশঙ্কা ছিল কি?

একটা সম্ভাব্য প্রতিযুক্তি এই যে, দু’জনকে শাস্তি দিয়ে আরও বহুজনকে সমঝে দেওয়া গেল, সেটার দরকার ছিল, অন্যায়ের কারবারিদের অঙ্কুরে বিনাশ না করলে তারা মাথায় চড়ে বসবে। হতে পারে, কিন্তু উল্টোটাও হতে পারে। বিদ্বেষ ও বিভাজনের যে রাজনীতি এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় বিপদ, সমাজের একটা বড় অংশের মনে তার প্রতি বেশ কিছুটা আনুকূল্য আছে, এই সত্য অস্বীকার করলে সেটা হবে ভাবের ঘরে ডাকাতি। ঠিক সেই কারণেই, যদি ওই রাজনীতির প্রবক্তাদের কুকথার সমুচিত জবাব না দিয়ে, অর্থাৎ বিনা পত্রপাঠেই, তাড়িয়ে দিই, তা হলে সমাজের বড় অংশটার মন তাদের মতামতের প্রতি আরও বেশি অনুকূল হয়ে পড়বে না তো? আমরা আমাদের উদার ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীলতার পবিত্র অহংকার নিয়ে সেই সমাজ থেকে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব না তো? যাদবপুরের ক্যাম্পাসে সাম্প্রদায়িকতা বা প্রাদেশিকতার কোনও জায়গা নেই, সেটা খুবই আনন্দের কথা। কিন্তু ক্যাম্পাসের বাইরে?

এবং, ক্যাম্পাসের ভিতরেও সব মনের খবর ষোলো আনা জানা আছে তো আমাদের?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE