উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ শাসক কিম জং উন। ফাইল চিত্র।
পাড়ার কারও সঙ্গে তেমন সদ্ভাব নেই মহোদয়ের। প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাঁর আদান-প্রদান বলতে তীব্র বাক্যবাণ আর প্রচণ্ড রক্তচক্ষু। অসদ্ভাবের কারণে দিন দিন অসহযোগিতা বাড়ছে, অন্যান্য অঞ্চলেও মহোদয় সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব চারিয়ে যাচ্ছে, ফলত নানা অবরোধ তৈরি হচ্ছে। আর অবরোধ যত বাড়ছে, মহোদয়ের রোষানল ততই দাউদাউ করে উঠছে। ঘরের ভিতরে হাঁড়িটা ঠিত মতো রোজ চড়ছে কি না, এখন হাঁড়ি চড়লেও ভবিষ্যৎ নিশ্চিন্ত কি না, সে সব বিষয়ে খুব বেশি ভাবিত সম্ভবত নন তিনি। রোজ ঘরে গোলা-বারুদ, কার্তুজ স্তূপীকৃত করছেন। রাগে গরগর করতে করতে মাঝে-মধ্যে ছাদে উঠছেন, এ দিকে-ও দিকে গুলি ছুড়ে দিচ্ছেন। প্রচণ্ড শব্দে আজ এঁর বাড়ির, কাল ওঁর বাড়ির মাথার উপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে গুলি। গোটা পাড়ার শান্তিভঙ্গ হচ্ছে, তীব্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। কিন্তু মহোদয় রোষ-মগ্ন, ক্রোধ-বিভোর, সৃষ্টিছাড়া।
যে চিত্রকল্পটা জন্ম নিল উপরের বর্ণনায়, তার নিখুঁত উদাহরণ হলেন কিম জং উন। গণতান্ত্রিক জনপ্রজাতন্ত্রী কোরিয়া অর্থাৎ উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ শাসক তিনি। ‘কমিউনিস্ট’ রাষ্ট্রটির সর্বোচ্চ পদ এবং শাসক দল ওয়ার্কার্স পার্টির শীর্ষ আসন তিনি কতটা জনগণতান্ত্রিক উপায়ে পেয়েছিলেন, সে নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বংশানুক্রমিক ধারায় পিতামহ কিম ইল সুং এবং পিতা কিম জং ইলের পরে যে ভাবে কিম জং উন উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ আসনে আসীন হয়েছেন, তাতে রাজতন্ত্র বা পরিবারতন্ত্রের প্রগা়ঢ় ছায়া। তবে আজকের তর্ক তা নিয়ে নয়। আজকের প্রশ্ন মানব সভ্যতার প্রতি কিম জং উনের দায়বদ্ধতা নিয়ে। তিনি যা করছেন, যে প্রচণ্ড সামরিক আস্ফালন দেখাচ্ছেন, যে রকম বিপজ্জনক ভঙ্গিতে গণবিধ্বংসী অস্ত্রশস্ত্র প্রয়োগ করে বহুবলের অবান্তর প্রদর্শনী সাজাচ্ছেন, তার গর্ভে যে মানব সভ্যতার চরম বিপর্যয় ছাড়া আর কিছুই লুকিয়ে নেই সে কথা কি কিম বুঝতে পারছেন না?
লেনিন ছাত্রদের পাঁচটি শ্রেণিতে বিভক্ত করেছিলেন— ১. কেবলমাত্র বিদ্যোৎসাহী, ২. উদারপন্থী, ৩. গণতান্ত্রিক, ৪. বিপ্লবী, ৫. প্রতিক্রিয়াশীল। চতুর্থ শ্রেণিটিই সমাজবাদ বা বিপ্লবের প্রাণবায়ু বলে তিনি মনে করতেন। চেষ্টা করলে দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণিকেও বিপ্লবে সামিল করা সম্ভব বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণিটি অত্যন্ত বিপজ্জনক, ওই শ্রেণিই সমাজবাদের তথা বিপ্লবের সবচেয়ে বড় শত্রু— লেলিনের মত মোটের উপর এমনই ছিল। সুতরাং বিশ্ব জুড়ে সমাজবাদী বা কমিউনিস্টদের মতও এমনই। কিন্তু এক কমিউনিস্ট নামধারী শাসকই আজ প্রতিক্রিয়াশীলতার যাবতীয় উদাহরণকে হার মানিয়ে দিচ্ছেন। বৈপরীত্যের চরম নিদর্শন সেখানেই।
আরও পড়ুন: ফের মাথার উপর দিয়ে উত্তর কোরীয় ক্ষেপণাস্ত্র, হুঁশিয়ারি দিল জাপান
কমিউনিস্ট বলেই এই আচরণ কিম জং উনকে মানাচ্ছে না, অন্য যে কোনও রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গেই এই আস্ফালন মানানসই, এমন কথা কিন্তু বলছি না। দর্শন বা জীবনবোধ তো দূরের কথা, মনুষ্যত্বের সঙ্গেই খাপ খায় না এই আস্ফালন। পরমাণু অস্ত্রের ভয়াবহতা ঠিক কেমন, ১৯৪৫ সালের ৬ অগস্ট এবং ৯ অগস্টই তা টের পেয়েছিল মানবজাতি। হিরোশিমা আর নাগাসাকির শরীরে আজও ক্ষত। সময় অনেক এগিয়েছে, পরমাণু অস্ত্র অনেক আধুনিক তথা শক্তিশালী হয়েছে, পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের সংখ্যাও বেড়েছে। আজকের ধ্বংসলীলা কিন্তু আরও মারাত্মক হবে অতএব। সঙ্কট ঘনালে তা কিন্তু কোনও শহরে, কোনও দেশে, কোনও অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকবে না, গোটা মানচিত্রটা বীভৎস হয়ে উঠবে। এই সাধারণ এবং অমোঘ সত্যটা উপলব্ধি না করার মতো মূঢ় তো আর কোনও রাষ্ট্রনায়কই নন। তা-ও এমন ভয়ঙ্কর প্ররোচনা কেন? কেনই বা নীরব থেকে বা অপেক্ষাকৃত নরম থেকে এই বিপজ্জনক আস্ফালনকে প্রশ্রয় দেওয়ার চেষ্টা কোনও কোনও বৃহৎ শক্তির তরফে থেকে?
রাষ্ট্রপুঞ্জ বার বার সতর্ক করছে, কাজ না হওয়ায় উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করছে। অধিকাংশ দেশ উত্তর কোরিয়ার সঙ্গ এড়িয়ে চলছে। পরমাণু কর্মসূচি রুখতেই এই আন্তর্জাতিক চাপ উত্তর কোরিয়ার উপরে। কিন্তু কিম জং উনের কাছে কোনও আন্তর্জাতিক জনমত, কোনও নিষেধাজ্ঞা, কোনও অবরোধই বড় নয়। ভয়ঙ্কর থেকে ভয়ঙ্করতর অস্ত্র তৈরিতেই যেন মোক্ষ তাঁর। দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে উত্তর কোরিয়া। পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে, একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে, মার্কিন সামরিক ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে, জাপানকে পরমাণু বোমার আঘাতে সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়ার কথা বলছে, আমেরিকাকে ছাই করে দেওয়ার শাসানি দিচ্ছে। পাল্টা শাসানিও আসছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই। কিম জং উন তাতে যেন আরও মরিয়া হয়ে উঠছেন। জাপানের উপর দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে দিচ্ছেন প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে।
শুক্রবার হোক্কাইডোর আকাশ দিয়ে উড়ে গিয়েছে কিমের যে ক্ষেপণাস্ত্র, সেই ক্ষেপণাস্ত্র সবচেয়ে স্পষ্ট করে দুটো বার্তা দিতে চেয়েছে। প্রথম বার্তা হল, জাপানের উদ্বেগ বা হুঁশিয়ারিকে গ্রাহ্যই করে না উত্তর কোরিয়া। দ্বিতীয় বার্তাটা নিহিত, ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লায়। যতটা পথ অতিক্রম করে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে আঘাত হেনেছে ক্ষেপণাস্ত্র, তাতে স্পষ্ট যে, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের মার্কিন দ্বীপ তথা সামরিক ঘাঁটি গুয়াম এখন উত্তর কোরিয়ার অস্ত্রের নাগালে। উত্তপ্ত সময়ে দাঁড়িয়ে এই ধরনের বার্তা দেওয়ার চেষ্টাকে কাণ্ডজ্ঞানহীন প্ররোচনা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। গোটা মানবজাতিকে অস্তিত্বের সঙ্কটে ফেলে দিতে পারে, এমন বীজই নিহিত রয়েছে এই প্ররোচনায়।
কিম জং উন গোটা মানবজাতিকে অপমান করছেন। মানব সভ্যতার অস্তিত্বের চেয়ে আত্মম্ভরিতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ যেন তাঁর কাছে। এই মানসিকতা নিয়ে রাষ্ট্রনায়ক হওয়া যায় না। রাষ্ট্র মানুষের জন্য, মানুষ রাষ্ট্রের জন্য নয়, এ কথা সম্ভবত কিম উপলব্ধি করেন না।
দায় অবশ্য বৃহৎ শক্তিগুলোকেও নিতে হবে। বৃহৎ শক্তি হিসেবে যে সব দেশ গোটা বিশ্বের কাছ থেকে সমীহ দাবি করে, বছরের পর বছর ধরে কোরিয়া সমস্যার সমাধান তারা করতে পারছে না কেন, এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। ক্ষমতার আস্ফালনে কিন্তু মাহাত্ম্য নেই, মাহাত্ম্য দায়বদ্ধতার প্রমাণ দেওয়ায়। দায়িত্বহীন ক্ষমতা ভোগের প্রবণতা কোথাও কোথাও তৈরি হয়েছিল বলেই উত্তর কোরিয়ার মতো অঙ্কুশ মাথা তুলেছিল। মানবজাতিকে সুরক্ষিত রেখে কী ভাবে এই কাঁটা তুলে ফেলা যায়, এ বার সে পথই খুঁজতে হবে। তবে সময় বেশি নেই, পথটা খুব তাড়াতাড়িই খুঁজতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy