Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

প্রস্টেট ক্যানসার বাড়ছে, বাড়ছে জেতার ক্ষমতাও। কী ভাবে? জেনে নিন

প্রস্টেট ক্যানসারের প্রকোপ বাড়ছে ঠিক, কিন্তু উন্নত চিকিৎসার গুণে এই রোগকে আর অপরাজেয় বলা যায় না।প্রস্টেট ক্যানসার আজকের রোগ নয়। তবে অধুনা হু-হু করে বাড়ছে এর সংখ্যা। আমেরিকার ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট-এর হিসেবে সংখ্যার বিচারে পুরুষদের ক্ষেত্রে নন-স্কিন ক্যানসারের শীর্ষে আছে প্রস্টেট ক্যানসার। দেখা যাচ্ছে, ফুসফুসের ক্যানসারের পরে এই ক্যানসারেই সবচেয়ে বেশি পুরুষ মারা যাচ্ছেন।

ডা. অমিত ঘোষ
শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০০:১৬
Share: Save:

প্রস্টেট ক্যানসার আজকের রোগ নয়। তবে অধুনা হু-হু করে বাড়ছে এর সংখ্যা। আমেরিকার ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট-এর হিসেবে সংখ্যার বিচারে পুরুষদের ক্ষেত্রে নন-স্কিন ক্যানসারের শীর্ষে আছে প্রস্টেট ক্যানসার। দেখা যাচ্ছে, ফুসফুসের ক্যানসারের পরে এই ক্যানসারেই সবচেয়ে বেশি পুরুষ মারা যাচ্ছেন। কিছু দিন আগেও একে পশ্চিম গোলার্ধের রোগ বলেই মনে করা হত, তবে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্যাথোলজি প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ভারতেও প্রস্টেট ক্যানসার আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামীণ মানুষেরা শহরমুখী হচ্ছেন, সচেতনতা বাড়ছে এবং চিকিৎসা পরিষেবা সহজসাধ্য হয়ে পড়ায় অনেক বেশি মানুষের মধ্যে এই রোগের বিস্তার ধরা পড়ছে, তা ছাড়া জীবনশৈলী, খাদ্যাভ্যাস এবং আর্থ-সামাজিক প্রতিবেশে বিস্তর পরিবর্তন এসেছে।

প্রস্টেট ক্যানসার নির্ধারণের মস্ত হাতিয়ার পিএসএ বা প্রস্টেট স্পেসিফিক অ্যান্টিজেন টেস্ট। এটা একটা সামান্য রক্তের পরীক্ষা। স্বাভাবিক অবস্থায় রক্তের পি এস এ মাত্রা ১ থেকে ৪-এর মধ্যে থাকে। বেশ কিছু দিন আগে আমার কাছে বছর ষাটের এক ভদ্রলোক চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন। তাঁর পিএসএ পরীক্ষায় মান ছিল ১০। ইউরিন কালচারে তাঁর ইউরিনারি সংক্রমণ ধরা পড়ে। অ্যান্টিবায়োটিক-এ তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান। আসলে, পি এস এ পরীক্ষা প্রস্টেট ক্যানসার নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা নিলেও অন্য কয়েকটি রোগেও এর মান বাড়তে পারে। তাই পি এস এ-র মান বেশি মানেই প্রস্টেট ক্যানসার হয়েছে, এমন সিদ্ধান্ত করা যায় না।

আর এক ভদ্রলোকের কথা বলি। বেড়ে যাওয়া পিএসএ নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন সাত বছর আগে। ইউরিন কালচারে কোনও সংক্রমণের সন্ধান না পাওয়ায় তাঁকে এমআরআই করতে বলি। সেখানে ইতিবাচক সংকেত মিলতেই তাঁর বায়োপসি করা হয়। বায়োপসিতে ক্যানসারের খোঁজ মিলল। ক্যানসার গ্রেড নির্ধারণে গ্লিসান স্কোর বলে একটি পদ্ধতি আছে, যাতে আগ্রাসী ক্ষমতার বিচারে ১ থেকে ১০ নম্বর দেওয়া হয়। তাঁর গ্লিসান স্কোর ছিল ৫-এরও কম, অর্থাৎ তাঁর লো গ্রেড ক্যানসার হয়েছিল। পারিবারিক ইতিহাস ও খাদ্যাভ্যাসের বিষয়ে বিস্তারিত জেনে অন্য কোনও ঝুঁকির সন্ধান না পেয়ে তাঁকে দীর্ঘকালীন পর্যবেক্ষণে রাখা হল। বছর বছর এমআরআই করে পাঁচ বছর বাদে দেখা গেল তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছেন। আজ ৭৫ বছর বয়সেও তিনি দিব্যি হেসেখেলে বেড়ান। কখনও কখনও আমার চেম্বারে এসে গল্প করে যান।

সবার যে লো গ্রেড ক্যানসার হয় এমন নয়। আর এক ভদ্রলোক, বর্ধিত পিএসএ-র পাশাপাশি তাঁর গ্লিসান স্কোর ছিল ৭। এমআরআই স্ক্যান জানায়, রোগের বিস্তার হয়নি। তবে তাঁর পরিবারে প্রস্টেট ক্যানসারের ইতিহাস ছিল। সুতরাং তাঁর ক্ষেত্রে ঝুঁকি ছিলই। আমি তাঁকে বলি যে, অস্ত্রোপচার করে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা সম্ভব। রেডিয়োথেরাপিও করা যেতে পারে, তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক বেশি। যেহেতু তাঁর বয়স সত্তরের আশেপাশে, কার্ডিয়াক সমস্যা নেই, অন্যান্য ঝুঁকিও কম, তাই র‌্যাডিক্যাল প্রস্টেটেক্টোমির সাহায্যে তাঁর প্রস্টেট গ্ল্যান্ড ও গ্ল্যান্ড সংলগ্ন লিম্ফ নোড সম্পূর্ণ ভাবে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। নানা ভাবে এই অস্ত্রোপচার করা হয়। তার মধ্যে একটি পদ্ধতিতে দূরনিয়ন্ত্রিত রোবোটিক ব্যবস্থার সাহায্যে গোটা প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আর সেই রোবোটের নিয়ন্ত্রক হিসেবে থাকেন কোনও সার্জন। প্রচলিত ল্যাপারোস্কোপির চেয়ে ঢের বেশি সুবিধে মেলে এখানে। আগের দিন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে পরদিন পাঁচটা ফুটো করে এই ব্যবস্থায় প্রস্টেট গ্ল্যান্ড সম্পূর্ণ ভাবে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। রক্তক্ষরণ ও ব্যথা হয় না বললেই চলে। রোগী দু’দিনের মধ্যে বাড়ি চলে যেতে পারেন। দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন।

আমার কাছে এমন অনেক রোগীও আসেন, যাঁদের পিএসএ হয়তো ৫০-এরও বেশি এবং গ্লিসান স্কোর ১০। আগ্রাসী চরিত্রের ক্যানসারের শিকার তাঁরা। হাড়ের স্ক্যান করে পজিটিভ ফল পাওয়া গেলে এঁদের হরমোন চিকিৎসা শুরু করা হয়। দু’তিন বছর দিব্যি ভাল থাকেন, তার পরে কেমোথেরাপি শুরু করে আরও দু’বছর পর্যন্ত জীবন দীর্ঘায়িত করা যায়। এই যে এক জন রোগীর জীবনের সঙ্গে সঙ্গে চলা, এটা আমার কাছে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং।

আজ থেকে প্রায় ৩৪ বছর আগে যখন এ শহরের এক মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে বেরোলাম, তখন থেকে আজ পর্যন্ত গঙ্গার বুক দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। ধাপে ধাপে উন্নত হয়েছে চিকিৎসাবিজ্ঞানও। তখন প্রস্টেট ক্যানসারের বায়োপসি রিপোর্টে বিস্তারিত কিছুই থাকত না। বোঝা যেত না ক্যানসার ঠিক কী পর্যায়ে (গ্রেড কিংবা গ্লিসান স্কোর) আছে। খোঁজ নেওয়া হত না রোগীর পরিবারে এই ক্যানসারের প্রবণতা আছে কি না। চিকিৎসা বলতে ছিল হরমোন ম্যানিপুলেশন। তাই সে সময় প্রস্টেট ক্যানসার ছিল অপরাজেয়। আজ প্রস্টেট ক্যানসার যেমন বাড়ছে এটা যেমন ঠিক, তেমনই উন্নত চিকিৎসার গুণে এই রোগকে ঠিক অপরাজেয় বলা চলে না। প্রস্টেট ক্যানসারের এই প্রাবল্যের মধ্যেও আমরা ঘায়েল না হয়ে যুদ্ধ চালাতে পারছি। সিংহভাগ ক্ষেত্রে জিতছিও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE