Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

দৃষ্টান্ত

পূরবীর কাজটি সহজ ছিল না। কোনও জনজাতির একটি দীর্ঘ দিনের প্রথায় বাধা দেওয়া কঠিন। আরও কঠিন সামাজিক উচ্চাবচতার ধাপগুলিকে অস্বীকার করিতে পারা।

শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৮ ০০:২৪
Share: Save:

নেহাত চাকুরির দায়? সেই তাগিদই কি পূরবী মাহাতোকে আদিবাসী বৃদ্ধদের সম্মুখে নতজানু করিল? সেই দায় কখনও ছিল না। শিকার উৎসবের রীতি মানিয়া আদিবাসীরা লালগড়ের জঙ্গলে প্রবেশ করিলে যদি কোনও ক্ষতি হইত, তাহার দায় অতিরিক্ত জেলা বনপালের উপর বর্তাইত না। বিশেষত, তিনি যে আদিবাসীদের থামাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, তাহার যথেষ্ট প্রমাণও ছিল। অতএব, পূরবী মাহাতো একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া ক্ষান্ত হইতে পারিতেন। কিন্তু, তিনি থামেন নাই। মৌখিক অনুরোধে কাজ না হওয়ায় শেষ অবধি তিনি আদিবাসী বৃদ্ধদের পায়ে ধরিয়াছেন। বলিয়াছেন, জঙ্গলে প্রবেশ করিতে হইলে তাঁহাকে মারিয়া তবে যাইতে হইবে। শিকার উৎসব পালন করিতে আসা অধিকাংশ মানুষই সেই অনুরোধ আর ফিরাইতে পারেন নাই। পূরবী জিতিয়াছেন। তাঁহাকে অভিনন্দন জানানো পশ্চিমবঙ্গের কর্তব্য। তিনি জয়ী হইয়াছেন বলিয়া নহে। বলপ্রয়োগ না করিয়া, হিংস্রতার আশ্রয় না লইয়া, প্রয়োজনে নত হইয়াও যে জেতা যায়, সেই কথাটি ফের প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী সন্তুষ্ট হইতেন।

পূরবীর কাজটি সহজ ছিল না। কোনও জনজাতির একটি দীর্ঘ দিনের প্রথায় বাধা দেওয়া কঠিন। আরও কঠিন সামাজিক উচ্চাবচতার ধাপগুলিকে অস্বীকার করিতে পারা। অতিরিক্ত জেলা বনপালের পদটির সহিত শিকার করিতে আসা আদিবাসী বৃদ্ধের সামাজিক দূরত্ব কত আলোকবর্ষের, সে হিসাব সমাজ জানে। সরকারি ক্ষমতার অধিকারীরা সচরাচর হুকুম করিতে অভ্যস্ত। তাঁহারা ক্ষমতার অস্ত্রে কথা মানাইতে জানেন। যেখানে সে ক্ষমতা অচল, যেমন পাঁচ হাজার মানুষের সম্মিলিত চাহিদার সম্মুখে, তাঁহারা সেখানে রণে ভঙ্গ দেন। পূরবী নিজের পদাধিকারটিকে নিজের ব্যক্তিসত্তা ঢাকিতে দেন নাই। কোনও বয়োজ্যেষ্ঠকে অনুরোধ করিবার, কথা মানাইবার যে পন্থা সমাজে স্বীকৃত, অন্তত একদা স্বীকৃত ছিল, তিনি তাহা মানিয়াছেন। আত্মমর্যাদার প্রতি কতখানি বিশ্বাস থাকিলে নিজের মানকে এই ভাবে ভোলা চলে, তাহা ভাবিয়া দেখিবার মতো। পূরবী মাহাতোর সম্মানের ক্ষতি হয় নাই। স্থানীয় মানুষ তাঁহার ইচ্ছাকে সম্মান করিয়াছেন। এই ভাবেই দৃষ্টান্ত রচিত হয়।

তাঁহাকে দেখিয়া সরকারি কর্তারা অনেক কিছু শিখিতে পারেন। শিখিতে পারে বৃহত্তর জনসমাজও, যেখানে ক্ষমতার উচ্চাবচতাই সামাজিক আচরণবিধি স্থির করিয়া দেয়। প্রশাসনিকতা মানুষকে কেন্দ্র করিয়াই চলে। দরিদ্র, অশিক্ষিত, অন্ত্যজ মানুষ— ভারত নামক রাষ্ট্রটিতে এখনও যাঁহারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। রাষ্ট্রের নিকট তাঁহারা কিছু পরিষেবা পাইয়া থাকেন। কিন্তু, এক আনা পরিষেবার সহিত মিশিয়া থাকে পনেরো আনা অপমান, অবজ্ঞা, দুর্ব্যবহার। হাসপাতাল হইতে রেশন দোকান, সর্বত্রই তাঁহাদের মূল প্রাপ্তি অপমানের মুদ্রায়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাঁহাদের অবুঝ প্রশ্নে নাজেহাল হইয়া আধিকারিকরা দুর্ব্যবহার করিতেছেন। আবার, সেই ব্যবহারই অভ্যাস হইয়া দাঁড়ায়। পূরবীকে দেখিয়া সমাজ শিখিতে পারে, কী ভাবে সমমানুষের মর্যাদা দিয়াও অবুঝ বা অন্যায় দাবি হইতে মানুষকে সরাইয়া আনা যায়। কিন্তু, তাহার পূর্বে মানুষকে মানুষ জ্ঞান করিবার অভ্যাসটি তৈরি করা বিধেয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Purabi Mahato Government paradigm Lalgarh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE