Advertisement
১০ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ২

ডান্ডা উঁচা রহে হমারা

সত্যি বলব? প্রেসিডেন্ট হয়ে যাব ভাবিনি। দুড়ুমদাড়াম কমেন্ট করব, সব্বার পিলে চমকে ডানপটকান মারব, একে অপমান করব, তার ঘেঁটি ধরে না়ড়াব, এটুকুই মস্তিপ্ল্যান ছিল।

শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:১৫
Share: Save:

সত্যি বলব? প্রেসিডেন্ট হয়ে যাব ভাবিনি। দুড়ুমদাড়াম কমেন্ট করব, সব্বার পিলে চমকে ডানপটকান মারব, একে অপমান করব, তার ঘেঁটি ধরে না়ড়াব, এটুকুই মস্তিপ্ল্যান ছিল। এ হল রথের মেলায় পাগলের ফুর্তি। তাকে ঘিরে ভিড় জমে যায়, সে নেচেকুঁদে প্রচুর হাততালি কুড়োয়, শেষে সবাই নিজ নিজ পাঁপড়ভাজা খেয়ে বাড়ি ফিরে যায়, তাকে কেউ মনে রাখে না। অবশ্য মহৎ উদ্দেশ্য একেবারে ছিল না, তা নয়। ঢুকেছিলাম পদ্মবনে, ফুলুফুলু ভাবটাকেই আছড়ে ভাঙব, এই পতাকা পাকড়ে। পলিটিক্সের সংজ্ঞাটাকেই পালটে দেব, পলিটিকালি কারেক্ট হওয়ার মাথায় ঘোল ঢেলে প্রমাণ করব পৃথিবী হচ্ছে পাঁড় অভদ্রের পাট্টা নেওয়া জমি, মর্তে এই থিয়োরি আনব যে আদুড় ইচ্ছে আর রাষ্ট্রের ম্যানিফেস্টোর মধ্যে ফারাক থাকা ঠিক না: এই ছিল মনোবাঞ্ছা। জানতাম, প্রচুর টিআরপি কুড়োব। এও জানতাম, এ ভাবে আর যা-ই হোক প্রেসিডেন্ট হওয়া যায় না, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের তো না-ই। শেষ তিনটে ডিবেটে লেজেগোবরে হয়েছিলাম, এও গেয়ে রেখেছিলাম, ভোটের রেজাল্ট না-ই মানতে পারি। সবাই জানত আমি হারব, আমিও জানতাম হারব, আন্ডারডগের নিশ্চিন্ত কামড় বেধড়ক শানিয়ে দিব্যি সুখে হাস্যমুখে হেডলাইন দাবড়াচ্ছিলাম, টিভি শো’র লোক যখন আঙুল দেখিয়ে বলত ‘ক্লাউন!’, আমি ডাইরিতে লিখতাম, ‘থাকি পৃথিবীর সেরা শহরে: পাবলি-সিটি!’

কিন্তু ভগবানের মার দুনিয়ার বার। আমায় লোকে ভোট দিয়ে দিল। প্রমাণ করল, সব্বাই পছন্দ করে এমন মানুষ, যার কাণ্ডজ্ঞান কম, সভ্যতা নম্রতা নেই, মোটামুটি ভাবে খার আর বিষ-ঝাড়ার ওপর যে নিজ মনোভূমিটিকে যতনে সাজায়েছে। আসলে পাবলিক ও-রকমই, অ্যাদ্দিনে তারা আপনজন পেল। কিন্তু আমার হল মুশকিল। আমি তো লিটল ম্যাগাজিন। ফেসবুকের খিস্তিওয়ালা। কী করে মুচমুচে নিন্দে রটাতে হয় তা জানি, নিজে দায়িত্ব পেয়ে গেলে কেমনে ব্যাপার সামলাতে হয় তা তো ভাবিনি। সত্যি সত্যি একটা দেশ চালাতে গেলে কী করতে হয় রে! তখন কপাল ঠুকে ঠিক করলাম, আমাকে ও ভাবেই চালিয়ে খেলতে হবে। এক রকম ইমেজ দেখিয়ে সিংহাসনে বসছি, এ বার তো আর চকিতে গম্ভীর মুখ বাগিয়ে নিরামিষ স্যুপ সুড়ুৎ করতে পারি না। আমাকে পা নাচাতে নাচাতে হ্যামবার্গার চিবিয়ে ফোটো তুলতে হবে, হোয়াইট হাউসের মাঠে সার্কাস বসাতে হবে। আমি প্রথমেই আমার সভাসদের প্যাকিং বাক্সে এমন সব লোক বসাতে লাগলুম, নলেজ-ওয়ালাদের আত্মা ছানাবড়া। পরিবেশ দেখার তখ্‌তে এমন এক জনকে বসালাম, যে কিনা বিশ্বাসই করে না গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এ মানুষের হাত আছে। প্রতিরক্ষায় এমন লোককে বসালাম, যার নিক-নেম হল ‘পাগলা কুকুর’, সে অ্যায়সা যুদ্ধবাজ। নয় কেন? দেব-কে সিনেমা করতে গেলে নাচতে হবে, অ্যাকশন ভি দেখাতে হবে। গণতন্ত্রকে আমি বুঝিয়ে ছাড়ব, যা চাইছ বুঝেশুনে চাও বাপ, নইলে পস্তাতে হতে পারে, কারণ ফট করে প্রার্থিত জিনিসটা পেয়েও যেতে পারো!

ফোনও করছি র‌্যান্ডম। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টটাকে ফোন করে এক দিন খোশগল্প করলাম, তুমি খুব ভাল লোক, তোমার দেশে যাব। আবার তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টটাকে ফোন করে দিলাম, চিন এতে রেগে যাবে কি না, না ভেবেই। তাই নিয়ে এক্সপার্টগুলোর কী খ্যাচখ্যাচ! আরে ভাই, হাতের কাছে একটা ফোন আছে, কাজটাজ নেই, তা কাউকে একটা ডায়াল করতে মন নিশপিশ করবে না! সারা পৃথিবীর লোক যখন-তখন বন্ধুকে ফোন করে ‘কী র‌্যাঃ, তোদের ওখানে রোদ্দুর উঠেছে?’ ব্লা-ব্লা’চ্ছে না? আসলে কূটনীতির সবচেয়ে ঝঞ্ঝাট হল, আগে কূট, পরে নীতি। আমি সে সব মানব কেন? আমি ফর্ম-ভাঙা লোক, ইচ্ছে করেই আঁকার সময় ক্যানভাসটা খুঁচিয়ে ছিঁড়ে দেব, গদ্য লেখার সময় অনাবশ্যক চাড্ডি অশ্লীল শব্দ সেঁধিয়ে দেব। ফোন করেছি বলে যদি কোনও দেশের গোসা হয়, পরোয়া নেই, তাকেও ফোন করব। তাতেও যদি রাগ না পড়ে, তার ওষুধও আছে। অ্যাত্তগুলো মিসাইল গুদামে অ্যাদ্দিন ধরে পচছে, খানতিন টপকে দেব। আরে বাবা, ওগুলো বানানো হয়েছিল কেন? এ ভাবে ধুলো খেতে থাকলে তো মরচে পড়ে যাবে। তখন ঠিকঠাক কালীপুজো পেলেও আর সলতে ঝিকোবে না। লোকে তো আড়মোড়া ভাঙতেও শূন্যে ঘুসি ছোড়ে।

তবে, আমার সর্বোচ্চ প্রতিশ্রুতিটা আগে রাখতে হবে। লোক তাড়াও! আমার দেশে বসে হাবিজাবি জাতগুলো আমাদের চাকরি খাবে আর ভাত সাবাড় করবে, হচ্ছেনেকো। প্রথমেই তাড়াব ভারতীয়গুলোকে। এরা বহুত পড়াশোনা দেখায় আর মিনমিন ব্যবহারে লোকের মন ভেজায়। আমার সাফ কথা, সব ব্যাটার ভিসা কাড়ো আর ফেরত পাঠাও। ভারত এতে আমাকে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করবে, সন্দেহ নেই। ওরা মানবে, এ এক পিস দুরন্ত জাতীয়তাবাদী কম্ম। ওরা তো ক’দিন আগে পাকিস্তানি নায়ক-গায়কগুলোকে তাড়াল। কেন? না, তোরা বর্ডারে সেনা মারছিস, তোরা ভাগ। তা ভারতীয়রা তো আমার মেনল্যান্ডে লোকের ভবিষ্যৎ মারছে। তাই আমি যখন ওদের ডলার-রোজগার-করা বাগুইআটির ছেলেগুলোকে লাত্থি মেরে তাড়াব, সেই ডলারে ফুটানি মারা বাপ-মা’গুলো নির্ঘাত আমার নৈতিক সমর্থনে কাঁকাল বেঁকিয়ে নাচবে। ভারত যদি শুধু ভারতীয়দের হয়, আমেরিকা শুধু মার্কিনদেরই হওয়া উচিত। ওদের প্রধানমন্ত্রীটাকেও আমার হেভি পছন্দ। আমার মতোই না ভেবেচিন্তে কাজ করে, আমার মতোই ব্যাদড়া আর অহংকারী, আমার মতোই জাতিবিদ্বেষ ওসকাতে ভালবাসে। ও পেল্লায় খুশি হয়ে গাঁদাফুলের তোড়া পাঠাবে। নতুন ওয়ার্ক-ফোর্স পাঠালে বস, থ্যাংকু, এদের বসিয়ে দিচ্ছি নয়া প্লাস্টিকের নোট তৈরির কারখানায়!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE