ঝাড়খণ্ড
• ২৯ জুন, ২০১৭, রামগড়। আলিমুদ্দিন, ওরফে অসগর আলি। গাড়িতে গোমাংস, সন্দেহে খুন।
• ১২ মে, ২০১৭, সরাইকেলা খারসাওয়ান। শেখ সাজ্জু, শেখ সিরাজ, নইম, শেখ হালিম। পেশায় গরু-ব্যবসায়ী। ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে খুন।
• ১৮ মার্চ, ২০১৬, লাতেহার। মহম্মদ মজলুম ও ইমতিয়াজ খান। মেলা থেকে গরু কিনে ফিরছিলেন। গণপ্রহারের পর গলায় ফাঁস দিয়ে গাছে ঝুলিয়ে খুন। ইমতিয়াজের বয়স ছিল ১৫ বছর।
পশ্চিমবঙ্গ
• ২৩ জুন, ২০১৭, উত্তর দিনাজপুর। নাসিমুল হক, মহম্মদ সমীরুদ্দিন, মহম্মদ নাসির। গরু চুরির অভিযোগে পিটিয়ে খুন।
হরিয়ানা
• ২২ জুন, ২০১৭, ফরিদাবাদ। জুনেইদ খান। ইদের বাজার সেরে ট্রেনে বাড়ি ফেরার পথে মুসলমান পরিচিতির কারণে আক্রান্ত। পিটিয়ে খুন।
• ২৪ অগস্ট, ২০১৬, মেওয়াট। দম্পতি রশিদা ও ইব্রাহিম। গো-মাংস খান, এই অভিযোগে পিটিয়ে খুন। গুরুতর আহত আরও দুই। আরও দু’জন গণধর্ষিতা হলেন। এক জনের বয়স ১৬।
• ২ এপ্রিল, ২০১৬, কুরুক্ষেত্র। মস্তান আব্বাস। মহিষ কিনে বাড়ি ফিরছিলেন। গণপ্রহারে মৃত।
রাজস্থান
• ১৭ জুন, ২০১৭, প্রতাপগড়। জাফর হুসেন। মহিলারা প্রকাশ্যে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছেন, এমন ছবি তুলতে বাধা দেওয়ায় পিটিয়ে খুন।
• ৫ এপ্রিল, ২০১৭, অলওয়র। পেহলু খান। পেশায় গোয়ালা। মেলা থেকে গরু কিনে ফিরছিলেন। পাচারকারী সন্দেহে পিটিয়ে খুন।
• ৩০ মে, ২০১৫, নাগৌর। আবদুল গফফর কুরেশি। বাড়িতে ভোজ উপলক্ষে ২০০ গরু জবাই করেছেন, গুজব ছড়াল। সোশ্যাল মিডিয়ায় জাল ছবিও এল। পিটিয়ে খুন।
উত্তরপ্রদেশ
• ৩ মে, ২০১৭, বুলন্দশহর। গুলাম মহম্মদ। তাঁর এক আত্মীয় একটি হিন্দু মেয়েকে পালিয়ে বিয়ে করেছে, এই অভিযোগে পিটিয়ে খুন।
• ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, চরখি দাদরি। মহম্মদ আখলাক। ফ্রিজে গোমাংস আছে, এই অভিযোগে বাড়িতে চড়াও হয়ে পিটিয়ে খুন।
অসম
• ৪ এপ্রিল, ২০১৭, নগাঁও। আবু হানিফা ও রিয়াজুদ্দিন আলি। গরু চুরির সন্দেহে পিটিয়ে খুন।
গুজরাত
• ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, আমদাবাদ। মহম্মদ আয়ুব মেব। ট্রাকে গবাদি পশু নিয়ে যাচ্ছিলেন। ট্রাকটি দুর্ঘটনায় পড়ে, একটি বাছুরের মৃত্যু। পিটিয়ে খুন।
হিমাচল প্রদেশ
• ১৬ অক্টোবর, ২০১৫, সিরমার। নোমান। ট্রাকে গরু পাচার হচ্ছে, এই অভিযোগে পিটিয়ে মারল জনতা। গুরুতর আহত আরও চার। আহতদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করল পুলিশ।
জম্মু ও কাশ্মীর
• ৯ অক্টোবর, ২০১৫, উধমপুর। জাহিদ। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের ডাকা ধর্মঘটে আটকে থাকা ট্রাকে পেট্রোল বোম ছুড়ে মারা হল। আগুনে পুড়ে মৃত্যু। গুরুতর আহত আরও দুই।
মহারাষ্ট্র
• ৪ জুন, ২০১৪, পুণে। মহসিন সাদিক শেখ। দাড়ি আর মাথার টুপি দেখে মুসলমান বলে চিহ্নিত। কোনও এক মুসলমান ইন্টারনেটে শিবজি আর বাল থ্যাকারের ছবি বিকৃত করেছে, এই অজুহাতে হামলা। পিটিয়ে খুন।
(এই তালিকা শুধু মৃত্যুর, শনিবার লেখা প্রেসে যাওয়া অবধি। মৃত্যু হয়নি, কিন্তু মারাত্মক ভাবে আহত হয়েছেন আক্রান্ত সংখ্যালঘু মানুষরা— তেমন ঘটনা এই তালিকায় নেই।)
এই তালিকাটা দেওয়ার পর সম্ভবত আর লেখার কিছু থাকে না। সত্যি কথা বলতে, এটা নিবন্ধ নয়ও। এটা আসলে অভিযোগপত্র। তাঁদের প্রতি অভিযোগ, যাঁরা ভেবেছেন, মুসলমানগুলোকে একটু শায়েস্তা করা প্রয়োজন। যাঁরা ভেবেছেন, ছাপ্পান্ন ইঞ্চির মহানায়ক ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র করে তুলবেন, যেখানে মুসলমানরা বড় জোর দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকবে। ওপরের তালিকার প্রতিটি মৃত্যুর দায় তাঁদের ওপর সমান ভাবে বর্তায়।
অভিযোগ তাঁদের প্রতিও, ২০১৪ সালে শুধু মুসলমান হওয়ার অপরাধে মহসিন সাদিক শেখকে নিহত হতে দেখেও যাঁরা চুপ করে ছিলেন। যাঁরা মহম্মদ আখলাকের মৃত্যুর পরও ভেবেছেন, দোষ রাষ্ট্রের নয়, রাষ্ট্রপ্রধানের নয়। ইদের বাজার করে ফেরার পথে সতেরো বছরের জুনেইদ খানকে গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে মরতে হওয়ার পরেও যাঁরা বলে উঠতে পারেননি, ভারতে সংগঠিত ভাবে মুসলমান-নিধন চলছে। যাঁরা এই মারণযজ্ঞের প্রতিবাদ করতে পারেননি। যাঁরা জানতে চাননি, এই হত্যালীলার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে প্রধানমন্ত্রীর পুরো তিন বছর সময় লাগল কেন? এই মৃত্যুগুলোর দায় এড়ানোর উপায় তাঁদেরও নেই।
ভাগ্যক্রমে, এমন মানুষরা এখনও ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ নন। হাজার হোক, এখনও অবধি ২৯টা রাজ্যের মধ্যে মাত্র দশটায় মুসলমান পিটিয়ে মারা হয়েছে। এখনও দেশের বেশির ভাগ মানুষ বুঝতে পারেন, ইদের বাজার সেরে ফেরার পথে জুনেইদের মনে ঠিক ততখানিই আনন্দ ছিল, নিউ মার্কেট থেকে পুজোর শপিং করে ফেরার পথে যতখানি আনন্দ হয় তাঁদের ঘরের ছেলেটার। গণধর্ষিতা হলে ধর্মীয় পরিচয়ে যন্ত্রণার হেরফের হয় না। এখনও দেশের বেশির ভাগ মানুষ বোঝেন, মুসলমানরাও ঠিক হিন্দুদের মতোই মানুষ— ততখানিই পারিবারিক, ততখানিই কুচুটে, ততখানিই বাঁচতে ভালবাসা মানুষ। কিন্তু, এই কথাগুলো যাঁরা বোঝেন, তাঁদের মধ্যেও কি সবাই এই মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন? ভারতে যখন রাজনৈতিক রেটরিকে গরুকে মা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, তখন যাঁরা প্রতিবাদ করেননি, বলেননি যে এটা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র শানানোর প্রস্তুতিপর্ব, বলেননি যে খাদ্যাভ্যাস মানুষের মৌলিক অধিকার, অতএব তাতে হস্তক্ষেপ করা যায় না— আজকের নিধনযজ্ঞের দায় যে তাঁদের ওপরও এসে পড়ে।
বিজেপি ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতির পথে হাঁটছে দেখেও যাঁরা চুপ করে ছিলেন, যাঁরা মোদীর মাহাত্ম্যে অর্থনীতির হাল ফেরার খোয়াবে মগ্ন থেকে ‘রামজাদে-হারামজাদে’ বা ‘করবস্থান-শ্মশান’-এর তুলনা শুনেও না শোনার ভান করেছিলেন, যাঁরা দেশপ্রেমের জোয়ারে খেয়াল করতে পারেননি যে ভারতীয়ত্ব বলতে শুধু হিন্দুত্বকে বোঝায় না, ক্রিকেটে পাকিস্তানকে সমর্থন করলে রাষ্ট্র যখন রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেছে, তখন যাঁরা চুপ করে ছিলেন— এই মৃত্যুমিছিলের দায় তাঁদেরও। প্রত্যেকের, কারণ এই সম্মিলিত নীরবতাই ক্রমে মুসলিম-বিদ্বেষের রাজনীতিকে মান্যতা দিয়েছে। এই পরোক্ষ সহযোগিতাতেই বৈধতা পেয়েছে প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, নিজের হিন্দুত্ববাদী মনটাকে জাহির করার মধ্যে থেকে লজ্জা সম্পূর্ণ উবে গিয়েছে। এই বৈধতাই সাহস জুগিয়েছে হিংসার কারবারিদের। কাজেই, এই হত্যালীলার দায় তাঁদের প্রত্যেককে নিতে হবে, যাঁরা এত দিন প্রতিবাদ করেননি। প্রতিটি অন্যায়ের প্রতিবাদ করেননি।
এই দায় যদি বিবেকের কাছে অসহ ঠেকে, তবে গলা ফাটিয়ে বলুন, আমার নামে এই হত্যা নয়। আমার নামে সাম্প্রদায়িক বিভাজন নয়, ভারতের ওপর হিন্দুত্ববাদ চাপানো নয়। আমার নামে মুসলমান-বিদ্বেষ নয়। এত দিন যাঁরা এই কথাগুলো বলে উঠতে পারেননি, এখন বলুন।
এই মুহূর্তে বলুন, #NotInMyName.
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy