Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

জাতীয়তাবাদবিরোধী শব্দটি আক্রমণের মোক্ষম যুক্তি

ক’দিন আগেই উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ওই সর্বাত্মক জয়। এর পর এবিভিপি দিল্লি ইউনিভার্সিটি বা অন্য ইউনিভার্সিটিগুলোতে যে কী করবে, ভেবে খুব দুশ্চিন্তা হয়।

হিংসাতীর্থ: দিল্লিতে কলেজ ক্যাম্পাসে এবিভিপির লাগাতার হিংসাত্মক আস্ফালনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের জমায়েত। পিটিআই

হিংসাতীর্থ: দিল্লিতে কলেজ ক্যাম্পাসে এবিভিপির লাগাতার হিংসাত্মক আস্ফালনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের জমায়েত। পিটিআই

তনিকা সরকার
শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

ক’দিন আগেই উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ওই সর্বাত্মক জয়। এর পর এবিভিপি দিল্লি ইউনিভার্সিটি বা অন্য ইউনিভার্সিটিগুলোতে যে কী করবে, ভেবে খুব দুশ্চিন্তা হয়। এই তো, গত ২ ফেব্রুয়ারি রামজস কলেজে এবিভিপি অর্থাৎ আরএসএস-এর ছাত্র শাখার সদস্যরা সাধারণ ছাত্র এবং কিছু প্রসিদ্ধ শিক্ষকদের মারমুখী আক্রমণ করল। তার ফলে এক শিক্ষককে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হল। এক শিক্ষিকার চোখ লক্ষ করে চেয়ার ছোড়া হল। বহু ছাত্রছাত্রী গুরুতর আহত হল। রামজস কলেজে এই আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য যাঁরা, তাঁদের মধ্যে মুকুল মাঙ্গলিক বহুবিদিত একটি নাম। তাঁর বিষয়ে পরে লিখছি। বলতে না ভাল লাগলেও বলতে হবেই যে ওই দিন মেয়েদের ‘ভাগ রান্ডি ভাগ’ বলে তাড়া করার ঘটনারও সাক্ষী আছে। মোবাইলে ধর্ষণ এবং খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছে। তার পর থেকে দিল্লির কলেজগুলোতে যে কোনও সেমিনার বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে হলে এবিভিপির অনুমতি নিতে হচ্ছে। দিল্লির বাইরেও। প্রবীণ সমাজতাত্ত্বিক ঘনশ্যাম শাহকে জাতপাত নিয়ে বরোদা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কর্মশালায় বলতে দেওয়া হল না। রামজস কলেজে সে দিন ‘কালচার্স অব প্রোটেস্ট’ সেমিনার হওয়ার কথা ছিল, জেএনইউ-এর ইতিহাসের গবেষক ছাত্র উমর খলিদ ভারতে আদিবাসী আন্দোলন নিয়ে সেখানে কিছু বলতেন, তাই এত কাণ্ড। গত বছর উমরকে ‘অ্যান্টিন্যাশনাল’ অভিযোগে কয়েদে পাঠানো হয়। কিন্তু অভিযোগের সমর্থনে প্রমাণ না পাওয়ায় জামিনে মুক্ত তিনি।

উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনের পরে দিল্লি ইউনিভার্সিটির কলেজে হিংসাত্মক কার্যকলাপের কথা খানিকটা গৌণ মনে হতে পারে। মনে হতেই পারে, এ আর নতুন কী। ক্যাম্পাস ভায়োলেন্স বা ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক দলের মারামারি তো লেগেই আছে, পশ্চিমবঙ্গেও। এ ক্ষেত্রে দুটো বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা দরকার। রামজস কলেজের ব্যাপারটা কিন্তু দুই দলের হাতাহাতি নয়। সেখানে এক দল পড়ে পড়ে মার খেয়েছে, পালটা আঘাত করতে পারেনি। অর্থাৎ এখন যা হচ্ছে সেটা যুযুধান দুই পার্টির লড়াই নয়। পার্টিগত বিরোধের একটা নিজস্ব লজিক থাকে। এখানে কিন্তু একটা সার্বিক, সুপরিকল্পিত, সর্বভারতীয় ও সুদূরপ্রসারী অ্যাজেন্ডা কাজ করছে। ক্রমশ সেটা প্রকট হয়ে উঠছে। আমরা আগেই আঁচ করেছিলাম যে এমন কিছু ঘটবে, চিন্তাভাবনা, আত্মপ্রকাশের অধিকারের উপর খবরদারি চলবে। তবে সেটা এত দ্রুত হবে, আন্দাজ করতে পারিনি।

দুই, মুকুল মাঙ্গলিক বা প্রশান্ত চক্রবর্তীদের মতো যে অধ্যাপকরা সে দিন বা তার পর আক্রান্ত হলেন, তাঁরা কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন। মতাদর্শগত ভাবে বামপন্থী হলেও কোনও দলের সঙ্গে এঁদের যোগ নেই। এবিভিপি নিজেদেরই প্রকাশিত ভিডিয়োয় দেখছি মুকুল নিজেই ছাত্রদের সংযত করছেন। জাতীয়তাবাদবিরোধী স্লোগান উচ্চারণের চিহ্নও সেখানে নেই।

এই একটি শব্দ ‘অ্যান্টিন্যাশনাল’ বললেই হয়, আর কিছু ভাবতে হয় না, সব হিংসার স্বীকৃতি মিলে যায়। মনে পড়ে, কানহাইয়াকে কী ভাবে মাটিতে ফেলে টিভি ক্যামেরার সামনে মারধর করা হয়েছিল। কাউকে এর জন্য কোনও কৈফিয়ত দিতে হয়নি। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর: জনমানসেও কতটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন মিলেছিল। অর্থাৎ ওরা কত দূর এগিয়েছে, ওদের আদর্শ কতটা ছড়িয়েছে যে মানুষ চিন্তা করতেই ভুলে গিয়েছেন, দু-তিনটে শব্দ উচ্চারণ করলেই বিনা বিচারে সব মেনে নিচ্ছেন। আমার এক ছাত্রী আমেরিকায় পড়ায়, এক দিন সে দুঃখ করে বলল, ‘ট্রাম্প আসার পরে আমরা আমেরিকার ফ্ল্যাগ পোড়াতে গিয়েছিলাম। আমাদের বাধা দেওয়া হল।’ ভাবছিলাম, এ দেশে এ কাজ করতে গেলে ওদের কী হত। এ দেশে প্রতীকী কথা বা স্লোগানের প্রভাব অনেকগুণ বেশি। অবশ্য এই প্রভাবের অনেকটাই তৈরি-করা। কথা থেকে শুরু করে ভিডিয়ো, সবই অক্লেশে তৈরি করা যায় আজকাল।

কী দুর্ভাগ্য, কলেজের প্রিন্সিপালরাও অ্যান্টি-ন্যাশনাল-এর জুজু মানতে শুরু করেছেন। রামজসের প্রিন্সিপাল ৩৫ বছর কাজ করে ক’দিন আগে অবসর নিয়েছেন। তাঁর উত্তরাধিকারী বোধ হয় আর সেমিনার করার সাহস দেখাতে পারবেন না। প্রিন্সিপালদের বকলমে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে এবিভিপির অনুমতি নিয়ে কাজ করতে হবে। ওদের জোরের জায়গাটা কী? পড়াশোনার জোর? বুদ্ধির জোর? ওরা কি প্রমাণ করতে পারবে যে ওরা আমাদের সকলের থেকে বেশি বোঝে?

দুটো জিনিস লক্ষণীয়। মারপিট, গলা টিপে চুপ করানো, চিন্তা বা চিন্তার প্রকাশ থামানো, এগুলো করতে তুচ্ছাতিতুচ্ছ উপলক্ষও লাগে না। খালসা কলেজে একটা সেমিনার হবে। কী সেমিনার, আমরা তখনও জানতে পারিনি। প্রিন্সিপাল কাকে সবার আগে জিজ্ঞেস করলেন? এবিভিপি-কে। তা হলে আমরা স্বাধীন ভাবে সেমিনারও করতে পারি না? ক্রমশই বোঝা যাচ্ছে দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে এখন এবিভিপির অনুমতি ছাড়া কিছু হতে পারবে না। এবিভিপি যেই মুহূর্তে বলল যে এতে অ্যান্টিন্যাশনাল কিছু থাকলে আমরা হতে দেব না, সেই মুহূর্তে সেটা বাতিল হয়ে গেল। জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে নিবেদিতা মেননকে নিয়েও ঠিক সেটাই হল। তিনি তাঁর মত প্রকাশ করেছিলেন কাশ্মীর এবং উত্তরপূর্ব ভারত বিষয়ে, নিজের ইউনিভার্সিটি-তে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। সেই থেকে তিনি যেখানেই বলতে যান, সেখানে যাঁরা তাঁকে ডাকছে, তাঁদের সাসপেনশন পেতে হয়। মন্দের ভাল, সম্প্রতি কোর্টের হস্তক্ষেপে সেটা নাকচ হয়েছে। অর্থাৎ এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে যাতে নিবেদিতা মেননকে কেউ আর না ডাকে। অসাধারণ পরিস্থিতি। এক জন বিশ্ববিখ্যাত স্কলার, যিনি সারা পৃথিবীতে বক্তৃতা করে বেড়ান, তাঁকে তাঁর দেশে, তাঁর শহরে কেউ ডাকতে পারবে না।

দ্বিতীয়ত, আক্রমণের ধরনটা খেয়াল করা দরকার। জেএনইউ-তে কানহাইয়ার ক্ষেত্রে যা দেখেছিলাম, গত এক বছরে ব্যাপারটা একেবারে নতুন এক স্তরে উঠে গিয়েছে, লাগামছাড়া খুনে চেহারা নিয়েছে, জিঘাংসায় পরিণত হয়েছে। রবীশ কুমার সে দিন এক অনুষ্ঠানে এমন একটি না-হওয়া সেমিনারে কে কী বলতে পারতেন, সেই আলোচনা করেছেন। সেমিনার যদি হত, এবিভিপির তাতে আপত্তির কী কারণ থাকতে পারত, বোঝা মুশকিল। এবিভিপি তো ছাত্রদের দল, আরএসএসের ছাত্র শাখা। তারা কেনই-বা তাদের শিক্ষকদের থেকে বেশি জানবে যে কোন আলোচনাটা চলতে পারে, কোনটা পারে না? কোন যুক্তিতে ছাত্ররা অধ্যাপক প্রশান্ত চক্রবর্তী, মুকুল মাঙ্গলিক বা বিনীতা চন্দ্রের থেকে নিজেদের বেশি সমঝদার মনে করে? (চলবে)

ইতিহাসবিদ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের প্রাক্তন শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE