Advertisement
১৭ মে ২০২৪
মানুষকে ‘মানুষ’ ভাবা

গরিবকে ধারের চক্কর থেকে বার করে আনতে হলে কী করবেন?

শিশির কৌতূহলী চোখে শিবুদার দিকে তাকায়। উইল বেনিসের নাম তার অচেনা। 

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০৫
Share: Save:

সাহস করে একটা কথা বলব, শিবুদা?’ তপেশের মুখে এ-হেন প্রশ্ন শুনে খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান স্বয়ং শিবু সেনও। ‘বিনয়ের অবতার দেখছি আজ!’ শিবুদা বললেন। ‘কী বলবি বল, তবে মূর্খের মতো কথা বললে গাঁট্টা খাবি।’

‘বলছিলাম, র‌্যান্ডমাইজ়ড কন্ট্রোল ট্রায়াল বা আরসিটি আর বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স, দুটো খুব কাছাকাছি বলে মনে হচ্ছে সমানেই।’ কথাটা বলেই দু’হাত দিয়ে নিজের মাথা ঢাকে তপেশ।

শিবুদা হাত তুললেন, তবে গাঁট্টা মারতে নয়। তপেশের মাথায় একটা আলতো চাঁটি মেরে বললেন, ‘কেয়া বাত! একদম আমার মনের কথাটা বলেছিস দেখছি। আশ্চর্য, গত বছর ঠিক এই সময়টাতে উইল বেনিসের সঙ্গে এই কথাটাই হচ্ছিল। তখনও অবশ্য অভিজিৎ বিনায়কদের নোবেল ভবিষ্যতের গর্ভে।’

শিশির কৌতূহলী চোখে শিবুদার দিকে তাকায়। উইল বেনিসের নাম তার অচেনা।

‘বলব, বলব! কিন্তু, তার আগে, গোপাল একটু চা দে বাবা। বাতাসে একটা হিম-হিম ভাব হচ্ছে, দেখেছিস?’ শিশিরকে ঝুলিয়ে রাখেন শিবুদা।

‘এই আরম্ভ হল! আপনার মতো শীতকাতুরে লোক আর দুটো দেখিনি বাবা। নভেম্বরের কলকাতায় নাকি শীত করছে!’ তপেশ তার ফর্মে ফেরে।

গোপাল টেবিলে চা দিয়ে যায়। শিবুদা আয়েশ করে চুমুক দেন। চোখ বন্ধ করে ‘হুঁ হুঁ’ করে একটু সুর ভাঁজলেন। রামপ্রসাদী। তার পর বললেন, ‘প্রাগে অবিশ্যি নভেম্বরে হাড় হিম করা ঠান্ডা পড়ে না— মোটামুটি সহ্য করা যায়। তবে, উইল বেনিসের জন্য ভর সন্ধেবেলা খোলা রাস্তায় আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল, সেটা সুখকর অভিজ্ঞতা নয়।’ একটা সিগারেট ধরিয়ে বারকয়েক ধোঁয়া ছাড়লেন শিবুদা। ‘চেক রিপাবলিকের নাম পাল্টে এখন চেকিয়া হয়েছে, জানিস তো? সেই দেশের প্রাগ শহরের কথা বলছি। মিলান কুন্দেরার গল্পের প্রাগ।’

‘উইল বেনিস ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্ক, প্রাগ-এ বিহেভিয়রাল সাইকলজি পড়ায়। চমৎকার ছোকরা, শিকাগোয় যখন পিএইচ ডি করছিল, তখন আলাপ।’ শিশিরের দিকে তাকিয়ে বললেন শিবুদা। ‘কাজ করে বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স নিয়ে, কিন্তু আরসিটি নিয়ে গভীর আগ্রহ। বলছিল, ইতিহাসগত ভাবে দুটোকে কাছাকাছি বলা যায় না। বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স-এর জন্ম ড্যানিয়েল কানেম্যান আর এমস ট্‌ভরস্কির হাতে। কোনও পরিস্থিতিতে পড়লে মানুষ— র‌্যাশনাল বা সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত মানুষ— যে ভাবে সিদ্ধান্ত করবে বলে মূলধারার অর্থনীতি ধরে নেয়, তাকে চ্যালেঞ্জ করা, কার্যত ভুল প্রমাণ করাই ছিল কানেম্যানদের প্রাথমিক এবং মূল লক্ষ্য। তাঁদের এক্সপেরিমেন্ট ছিল মূলত ল্যাবরেটরিতেই। নব্বইয়ের দশকে অভিজিৎ, এস্থার এবং মাইকেল ক্রেমার যখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের র‌্যান্ডমাইজ়ড কন্ট্রোল ট্রায়ালকে নিয়ে এলেন উন্নয়ন অর্থনীতির গবেষণায়— কাউকে ভুল প্রমাণ করার চেয়েও অনেক বেশি জরুরি ছিল উন্নয়ননীতিতে থেকে যাওয়া ফাঁকগুলোকে চিহ্নিত করার কাজ। এবং, সেই গবেষণা তাঁরা করেছিলেন বাস্তবের জমিতে, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে।’

‘তপেশ যা বলল, বেনিস তো তার উল্টো কথাটা বলছেন দেখছি।’ সূর্য হিসেব মেলাতে পারে না।

‘উল্টো যে বলছে না, সেটা বোঝার জন্য আর একটু ধৈর্য ধরতে হবে যে।’ সূর্যের আপত্তি উড়িয়ে দেন শিবুদা। এক ঢোক জল খান, তার পর বলতে থাকেন, ‘আরসিটি হল একটা গবেষণাপদ্ধতি, আর বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স হল অর্থনৈতিক চিন্তার একটা ঘরানা— কাজেই, দুটো যে একেবারে তুল্যমূল্য নয়, এটা গোড়ায় বোঝা দরকার। বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স-এর গবেষণায় এখন আকছার আরসিটি ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু, মিলটা সেখানে নয়। উইল আমার সঙ্গে একমত হল যে দুটো ধারার মিল একেবারে মূলগত একটা বিশ্বাসে— দুটো ধারাতেই মানুষকে দেখা হয় মানুষ হিসেবে। দোষ-গুণ, যুক্তি-যুক্তিহীনতায় মেলানো-মেশানো মানুষ— আনবাউন্ডেড র‌্যাশনালিটিসম্পন্ন ‘ইকন’ নয়। দুটো ধারা যে মানুষকে একেবারে এক রকম ভাবে দেখে, তা নয়। বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স-এর তুলনায় আরসিটি মানুষের যুক্তিগ্রাহ্যতায় ভরসা করে অনেক বেশি। কিন্তু, একেবারে মূলে গেলে দেখবি, দুই ধারারই আসল কথা হল, র‌্যাশনালিটির অভাবেই হোক বা অন্য কোনও কারণে, এক জন ব্যক্তির ভাল থাকার পথে যেখানে বাধা তৈরি হচ্ছে, সেটাকে কী ভাবে দূর করা যায়, সেই তরিকা সন্ধান করা। এই যে তপেশের মনে হচ্ছে, আরসিটি আর বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স চরিত্রে বেশ কাছাকাছি, সেটা এই কারণেই। তাই তো?’

শিবুদার কথা শেষ হওয়ার আগেই গোপাল আবার চা দিয়ে যায়। শিবুদা চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘প্রাগের কাফে-তে বসে কথা হচ্ছিল চেন্নাইয়ের ফলের বাজারের, বুঝলি। সেন্ধিল মুলাইনাথনের কথা তো আগেই বলেছি। অভিজিৎ বিনায়কেরই ছাত্র। কথা হচ্ছিল ওর গবেষণা নিয়ে।’

‘সেই ফলের বাজার তো, যেটার কথা সেন্ধিল আর এলডার শাফিরের স্কেয়ারসিটি আর অভিজিৎ বিনায়কদের পুয়োর ইকনমিক্স, দুটোতেই আছে?’ প্রশ্ন করে সূর্য।

‘রাইট’, প্রশংসাসূচক মাথা নাড়েন শিবুদা। ‘বল দিকি, কোথায় এক রকম, আর কোথায় আলাদা হয়ে যায় অভিজিৎ বিনায়কদের আরসিটি আর সেন্ধিলদের বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স?’

‘অভিজিৎবাবুরাও সেন্ধিলের গবেষণার কথাই উল্লেখ করেছেন তাঁদের বইয়ে’, চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বলে সূর্য। ‘চেন্নাইয়ের যে বাজারটার কথা তাঁরা বলছেন, সেখানকার গরিব ফলওয়ালাদের মূল সমস্যা হল, প্রতি দিন সকালে এসে তাঁদের হাজারখানেক টাকা ধার নিতে হয় মহাজনের থেকে। সেই টাকা দিয়ে তাঁরা পাইকারদের থেকে ফল কেনেন, ফেরি করার জন্য ঠেলাগাড়ি ভাড়া নেন— আর দিনের শেষে টাকা ফেরত দিয়ে আসেন, সুদসমেত। সুদের পরিমাণ বিপুল— প্রতি দিন সাড়ে চার শতাংশের বেশি। যদি তাঁদের টাকা ধার করতে না হত, প্রতি দিন এই টাকাটাও তাঁদের লাভের মধ্যেই থাকত। অল্প দিনের মধ্যেই দারিদ্রের গণ্ডি টপকে যেতে পারতেন তাঁরা। এই সমস্যাটার সমাধানসূত্র হিসেবে অভিজিৎ বিনায়কদের লেখায় ক্ষুদ্রঋণের কথা এসেছে। গরিব মানুষকে অপেক্ষাকৃত কম সুদে ধার দিলে তাঁরা যে দারিদ্রের চক্কর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন, অভিজিৎরা সে কথা বলেছেন। সেন্ধিলদের গবেষণা গিয়েছে অন্য পথে— তাঁরা দেখিয়েছেন, গরিব মানুষের মাথায় সর্ব ক্ষণ এত রকম চিন্তার চাপ থাকে যে তাঁদের ভাবার ক্ষমতা কমে যায় সেই চাপে। ফলে, যুক্তির চেয়ে আবেগ তাঁদের চালনা করে বেশি। সেই কারণেই, কম সুদে ঋণ পাওয়ার পরও অধিকাংশ ফলবিক্রেতাই কিছু দিনের মধ্যে সেই টাকা বাজে খরচ করে ফের ধারের কবলে গিয়ে পড়েন। কাজেই, এই গরিবদের উপকার যদি করতেই হয়, তবে শুধু টাকা ধার দিলে হবে না, তাঁদের অন্যান্য চিন্তা দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে। যে ফলবিক্রেতা মা তাঁর বারো বছরের মেয়ের কাছে পাঁচ আর তিন বছরের দুই সন্তানকে রেখে সারা দিনের জন্য বেরোতে বাধ্য হন, তাঁর ভাল করতে চাইলে বাচ্চাগুলোর জন্য ক্রেশের ব্যবস্থা করতে হবে।’

‘অর্থাৎ, পলিসি প্রেসক্রিপশনে ফারাক থাকলেও দুই দলই আসলে পথ খুঁজছে, কী ভাবে গরিব মানুষকে তার র‌্যাশনাল সেল্ফ-এ— যুক্তিযুক্ত সত্তায়— এনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়।’ শিবুদা খানিক জিরিয়ে নিয়ে ফের চাঙ্গা। ‘মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই যুক্তিবোধ দ্বারা পরিচালিত কি না, সেই তর্কটা ছেড়ে দে— কিন্তু, পরিস্থিতি যে তাকে সব সময় যুক্তির পথে চলতে দেয় না, যুক্তির পথটা দেখতেই দেয় না, এটা নিয়ে আরসিটি আর বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স, দু’পক্ষই একমত। ক্যাপিটালিজ়মের সবচেয়ে বড় সমস্যাটার দিকে আঙুল তুলছে তারা।’

‘ও দিকে লোকে বলছে, আরসিটি হল ক্যাপিটালিজ়ম-এর একটা চক্রান্ত— বাজার যে গাড্ডা খুঁড়েছে, তাতে সামান্য জোড়াতালি দেওয়ার ব্যবস্থা’, শিশির বলে।

‘ক্যাপিটালিজ়ম-কে ডিফেন্ড করার দায় আমার কেন, বেশির ভাগ ভদ্রলোকেরই নেই’, শিবুদা এক মুহূর্ত সময় না নিয়েই উত্তর দিলেন, ‘কিন্তু, আহাম্মকি সহ্য করার ধৈর্যও নেই। ক্যাপিটালিজ়ম যে দুনিয়ার সবার উপকার করেনি, এটা বুঝতে টমাস পিকেটি হওয়ার প্রয়োজন নেই। আরসিটি মূলত ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থাতেই কাজ করছে, সেটা নিয়েও সন্দেহ নেই। কিন্তু, ক্যাপিটালিজ়মের উল্টোটা কী? সোশ্যালিজ়ম? একটা প্ল্যানড ইকনমির কথা ভাব— যেখানে প্ল্যানিং কমিশন বা পলিটবুরো বা অন্য কেউ একেবারে চূড়ায় বসে স্থির করে দিচ্ছে, কোন ক্ষেত্রের কোন কারখানায় কতটা উৎপাদন হবে, কোন চাষি কী ফলাবেন, কে কী কিনবে, কতটা কিনবে। একটু রং চড়িয়ে বলছি, কিন্তু মোদ্দা কথাটা ঠিক— সোশ্যালিজ়মে সাধারণ মানুষের ভাবার অধিকারও নেই, প্রয়োজনও নেই। রাষ্ট্রই সেই দায়িত্ব নিয়েছে। সেখানে আরসিটি কাজ করবে কী করে— যেখানে আরসিটির মূল কথাই হল মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে ঠিক পথে চালিত করা? ক্যাপিটালিজ়মকে দু’বেলা গাল পাড়, আপত্তি নেই— কিন্তু, মানুষকে মানুষ হিসেবে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী হিসেবে দেখতে হলে ক্যাপিটালিজ়মই ভরসা। হ্যাঁ, বাজার বহু ক্ষেত্রেই সেই অধিকারকে কার্যকর হতে দেয় না। কিন্তু, সেটা দেওয়ানোই তো কাজ।’

চেয়ারের পিছনে ঝুলিয়ে রাখা মাফলারটাকে গলায় জড়াতে জড়াতে শিবুদা উঠে পড়লেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Poverty Poor Economy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE