Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

ঘরের কাজের জন্য টাকা দেবেন না কেন

গায়ক, লেখক, বিজ্ঞানী, শিল্পীরা যদি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ভালবাসার কাজ করে থাকেন, তবে ঘরের কাজের ক্ষেত্রে আলাদা হবে কেন? বরং গৃহকর্ম সবৈতনিক হলে মেয়েদের বাইরে বেরনোর দরকার কমবে। না রী দিবসে আমরা নারীর সমস্যার কথা ভাবি আর শ্রমিক দিবসে ভাবি শ্রমিকদের কথা। কিন্তু নারী আর শ্রমিক, এই দুই বৃত্ত যেখানে পরস্পরকে ছেদ করে, সেখানে ‘ওম্যানস ল্যান্ড’-এর অন্ধকারে পড়ে থাকে অনেকটা নারীশ্রম, যার মূল্য কতটুকু, সেটাই প্রশ্ন। গৃহবধূদের কথা বলছি। মধ্যবিত্ত সংসারে যে মহিলারা জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের দায়িত্ব ২৪ গুণ ৭ হিসেবে পালন করেও কোনও দিন ঠিক ‘নিজের পায়ে দাঁড়াতে’ পারেন না, তাঁদের শ্রমের কথা নিয়েই এখানে একটু ভাবাভাবি।

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৬ ০০:০৭
Share: Save:

না রী দিবসে আমরা নারীর সমস্যার কথা ভাবি আর শ্রমিক দিবসে ভাবি শ্রমিকদের কথা। কিন্তু নারী আর শ্রমিক, এই দুই বৃত্ত যেখানে পরস্পরকে ছেদ করে, সেখানে ‘ওম্যানস ল্যান্ড’-এর অন্ধকারে পড়ে থাকে অনেকটা নারীশ্রম, যার মূল্য কতটুকু, সেটাই প্রশ্ন। গৃহবধূদের কথা বলছি। মধ্যবিত্ত সংসারে যে মহিলারা জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের দায়িত্ব ২৪ গুণ ৭ হিসেবে পালন করেও কোনও দিন ঠিক ‘নিজের পায়ে দাঁড়াতে’ পারেন না, তাঁদের শ্রমের কথা নিয়েই এখানে একটু ভাবাভাবি।

‘মেয়েলি’ কাজকারবারের মূল্যায়নের কথা উঠলেই লোকে খুব অবাক হয়, কারণ যুগ যুগ ধরে যে-সব কাজ মেয়েরাই পারেন আর করেন, সংসারে সেগুলোকে আদৌ মূল্যবান বলেই ভাবেন না। বাড়ির পুরুষটি বাইরে কাজ করেন— তাঁর কাজ, তাঁর বিশ্রাম এমনকী তাঁর বিনোদনটিও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাড়ির মহিলাটিকে ‘হাউসওয়াইফ’ বা ‘হোমমেকার’— যে নামই দিন, তাঁর কাজটা যেন কোনও কাজই নয়, এমনকী সেই রকম কাজে বিশেষ দক্ষতাও বলার মতো কিছু নয়— তা থোড়-বড়ি-খাড়ার মধ্যে থেকেই বিচিত্র পদের রান্না হোক, কাপড়ে সূক্ষ্ম নকশা তোলাই হোক কি বড়ি-আচার-উলবোনা-আলপনা থেকে ঘরদোর পরিপাটি সাজিয়ে রাখার নিপুণ ঘরকন্না হোক! অথচ খেয়াল করলে দেখবেন, দু’দিন একঘেয়ে রান্না খেতে হলে বা ঘরদোর অগোছালো থাকলে আপনারও ভাল লাগছে না। অর্থাৎ, ঘরের আরামটা হল টেক্‌ন ফর গ্র্যান্টেড। আপত্তিটা এখানেই। শ্রম বণ্টনের নিয়মে, যিনি ঘরে থাকেন, তিনি ঘরের কাজ করবেন, এমনিতে এর মধ্যে অন্যায় কিছু নেই। কিন্তু সেই কাজ ও দক্ষতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব না দেওয়াটা যে এক রকমের অজ্ঞতা, বলবার কথা সেটাই।

মেয়েলি কাজ এবং মেয়েলি গুণপনাকে এই যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা, এর কারণ হল, এই কাজগুলো সরাসরি ভাবে অর্থকরী নয়। দারুণ রান্না বা সেলাই করতে পারা, ঘর সাজানো, গান গাওয়া, সেবা করা— এই সব মেয়েলি গুণের এমনিতে কোনও মূল্য নেই, যতক্ষণ না তার থেকে কিছু উপার্জন হচ্ছে। সেই জন্যই বাইরে বেরিয়ে উপার্জন না করা পর্যন্ত এক জন নারী যথার্থ স্বাধীন হন না, তাঁর গুণাবলির বা মতামতেরও কোনও মূল্য থাকে না। তাই, যাঁর নিরন্তর সেবা বা পরিষেবাটুকু বাদ দিয়ে সংসার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না, তিনি নিজেই চিরদিন ‘আমি কিছু করি না’ জাতীয় হীনম্মন্যতায় ভুগেছেন আর মনে মনে চেয়েছেন যে, অন্তত তাঁর মেয়ে যেন সংসারের এই সব ‘থ্যাংকলেস জব’-এ আটকে না থেকে অর্থমূল্যে বিচার হয়, সেই রকম কিছু করে। যার ফল হল আজকের কর্মরতা মহিলা প্রজন্ম, যাঁরা সংসার ও চাকরি সামলে নেন, কিন্তু ওই তথাকথিত ‘মেয়েলি’ কাজগুলোর জন্য বেশি সময় দিতে চান না।

আর যাঁরা সে রকম হয়ে উঠতে পারেননি, শুধু ‘নিজের হাতে রোজগার’ করার তাগিদে তাঁরাও কেউ দিনের শেষে ব্লাউজে বোতাম পরাচ্ছেন, কেউ প্রসাধন সামগ্রীর এজেন্সি নিয়েছেন, কেউ দোকানের সেলসগার্ল হয়েছেন। এই কোনও কাজই তাঁদের ভালবাসার জন্য বা পারদর্শিতার চর্চার জন্য নয়, সংসার খরচে বিশেষ সুবিধে ঘটাবার মতো আয়ও নয়, কিন্তু সেটা তাঁর ‘নিজের রোজগার’। সেইটুকু উপার্জন না করতে হলে সেই মহিলা হয়তো সেই সময়ে নিজের শখেই কিছু সেলাই করতেন, নতুন কিছু রান্না করতেন, ঘর সাজাতেন, বা গান নিয়ে বসতেন; কিন্তু সেই ‘মেয়েলি’ কাজের কোনও অর্থমূল্য নেই, তা তাঁকে স্বাভাবিক মুক্তি দিতে পারেনি, তাই তাঁকে বিসর্জন দিতে হল স্রেফ উপার্জনের চাপে। সেইটুকু রোজগারের সময় বার করার জন্য তাঁরা অতিরিক্ত পরিশ্রম করেন। কিন্তু জানেন, এটুকু ছেড়ে দিলে তাঁর নিজের উপার্জন কিছু থাকবে না। স্বামীরা বলবেন ‘কাজটা ছেড়ে দাও, ওইটুকু টাকা আমিই তোমায় দেব’, কিন্তু দেবেন না। কারণ, গৃহশ্রম অ-মূল্য নয়, মূল্যহীন। অথচ মেয়েদের হাতের তৈরি বড়ি-আচার-নাড়ু-পিঠে বা হাতে সেলাই আসন-কাঁথা-সুজনিই আপনি কিনে আনছেন মেলা থেকে, তখন তা ‘মূল্যবান’।

এইখানে এসে মনে হয়, যদি এই মহিলারা ঘরের কাজের জন্য কিছু ধরাবাঁধা ‘মাইনে’ পেতেন, কেমন হত! এমন একটা নিয়মের কথা যদি ভাবা যেত, যাতে যে-কোনও বিবাহিত পুরুষের বেতনের একটা নির্দিষ্ট অংশ তাঁর স্ত্রীর (গৃহবধূ হলে) কাছে আসবে, যেটা ঘরের কাজ করার জন্য তাঁর বেতন। এটা ‘হাতখরচা’ নয় আর স্বামী এখানে দাতাও নয়। মহিলাটি ঘরের কাজের জন্য সহায়িকা রাখলে সেই বেতন থেকেই সহায়িকার মাইনে হবে। (ফলে পুরুষটিও কিছুটা শান্তি পাবেন এই ভেবে যে, তাঁর টাকাটার পুরোটা জলে যাচ্ছে না)। কিন্তু, এ ছাড়া সেই টাকা মহিলাটি কী ভাবে খরচ করবেন, সেটা তাঁর ব্যাপার। এই পদ্ধতি মেনে চললে, যে মহিলা নিজের হাতে সব করেন এবং যাঁর অনেক পরিচারিকা আছে, তাঁদের মধ্যে নিজস্ব উপার্জনের ভিত্তিতে একটা যুক্তিযুক্ত তফাতও থাকবে। আর যদি কোনও সংসারে শুধু মহিলাটিই বাইরে কাজ করেন, তবে একই ভাবে তাঁর স্বামীও বেতন পাবেন, আর সেটাও কোনও ভাবেই ‘বউ-এর পয়সায় খাওয়া’ হবে না।

এ প্রশ্ন উঠলেই সবাই এমন গেল-গেল রব তোলেন, যেন গৃহকর্মের পণ্যায়ন হলেই সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়বে, গৃহকর্মে যে ভালবাসার ছোঁয়া, তা নষ্ট হবে। কিন্তু গায়ক, লেখক, বিজ্ঞানী, শিল্পী সবাই যদি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ভালবাসার কাজ করে থাকেন, তবে ঘরের কাজের ক্ষেত্রে আলাদা হবে কেন? বরং গৃহকর্ম সবৈতনিক হলে মেয়েদের এই ‘নিজের পায়ে দাঁড়ানো’-র জন্য বাইরে বেরনোর দরকার কমবে আর সংসারের কাজে সময় দেওয়া বা ভালবাসাও বাড়বে বই কমবে না।

একটি প্রগতিশীল ইন্টারনেট পত্রিকায় প্রস্তাবটা পেশ করার পর, উচ্চশিক্ষিত পাঠকদের কাছ থেকে মতামত পাওয়া গেল: ১) গৃহবধূদের তো বিশেষ কিছু কাজ নেই, সবই পরিচারিকারা করেন (এ ভাবনা মূলত কর্মরতা মহিলাদের); ২) সংসার তো নিজের, নিজের কাজ করার জন্য মাইনে কেন; ৩) গৃহবধূর কাজ তো পরিচারিকার কাজেরই মতো, তার মাইনে কেন পরিচারিকার চেয়ে বেশি হবে; ৪) বরের মাইনের ওপর নির্ভর করে না থেকে নিজে যা পারে উপার্জন করলেই তো হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ, এলজিবিটি, সংখ্যালঘু, এমনকী পরিচারিকাদের সমস্যাও যাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, গৃহবধূদের সমস্যার সঙ্গে তাঁরা মোটেই রিলেট করেন না। এখানেই আসল অন্ধকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE