Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

মেয়েরা সংসার করবে, বিজ্ঞানীও হবে?

সানিয়া মির্জা দুঃখ করে বলেছেন, মেয়েরা যতগুলো লড়াইতেই জিতুক না কেন, তারা কখনওই ‘থিতু’ হয় না, যত দিন না তারা ‘মা’ হয়ে সংসারে ‘ঠিকমতো’ ঢুকে পড়তে পারে।

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

সানিয়া মির্জা দুঃখ করে বলেছেন, মেয়েরা যতগুলো লড়াইতেই জিতুক না কেন, তারা কখনওই ‘থিতু’ হয় না, যত দিন না তারা ‘মা’ হয়ে সংসারে ‘ঠিকমতো’ ঢুকে পড়তে পারে। তবে, এটা আসলে অর্ধেকটা বলা হল। পুরোটা বলতে গেলে, কেরিয়ার গড়তে গড়তে যে-মেয়েরা ‘থিতু’ হয়ে যায়, যতই ভাল রেজাল্ট আর ডিগ্রি থাকুক, বাস্তবে তারা অনেকেই আর খুব বেশি দূর এগোতে পারে না। কী এক আশ্চর্য বাধায় ঠেকে যায়। এই কারণেই মেয়েদের উচ্চশিক্ষাকে অনেকেই ‘লিকিং পাইপ’-এর সঙ্গে তুলনা করেন।

বিজ্ঞানে পিএইচ ডি করেও সংসারের চাপে যে বিরাট সংখ্যক মেয়েরা হারিয়ে যায়, তাদের গবেষণায় ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের (ডি এস টি) একটা পদক্ষেপ হল ‘মহিলা বিজ্ঞানী’ প্রকল্প। এর নিয়ম অনুযায়ী পিএইচ ডি ডিগ্রিধারী মহিলারা তিন বছরের জন্য কোনও গবেষণাকেন্দ্রে একটা ‘প্রজেক্ট’ এনে গবেষণা করতে পারেন। তাঁদের নির্দিষ্ট মাইনে বা ‘ফেলোশিপ’ আর গবেষণার খরচের জন্য একটা ভাল অংকের আর্থিক অনুদান ডি এস টি মঞ্জুর করে। মহিলাটিই এই প্রজেক্টের সর্বেসর্বা, অনুদান তাঁর নামেই আসবে। যেখানে তিনি কাজ করবেন, সেই প্রতিষ্ঠান তাঁকে পরিকাঠামোগত সাহায্য করবে, সে জন্য অনুদানের একটা অংশ তাঁরা পাবেন। আর কাজটা তিনি যে ল্যাবরেটরিতে করবেন, সেই বিজ্ঞানী হবেন তাঁর ‘মেন্টর’। মহিলা বিজ্ঞানীটি কাজের ব্যাপারে বা অন্যান্য সুবিধে-অসুবিধে নিয়ে মেন্টরের সঙ্গেই আলোচনা করবেন।

ব্যাপারটা দেখতে শুনতে ভালই। বিজ্ঞান গবেষণায় যাঁরা লেগে থাকতে চান বা ফিরে আসতে চান, তাঁদের পক্ষে একটা ভাল সুযোগ। কিন্তু একে মহিলা, তাতে আবার সংসারী, বিজ্ঞানের জগতে তাঁদের ‘ফিরে আসা’কে গুরুত্বপূর্ণ ভাবার মানসিকতা বড়ই দুর্লভ। ওখানে সানিয়া মির্জার মতোই বলতে হয়, যত ভাল গবেষণাই করুক, মহিলা বিজ্ঞানীদের মহিলা বলেই ভাবা হয়, বিজ্ঞানী বলে নয়। তাই শুরু থেকেই এই প্রকল্প চলে হেলাফেলার মধ্যে দিয়ে। প্রজেক্ট মঞ্জুর হওয়ার আগে অনন্তকাল অপেক্ষা করতে হয়, প্রজেক্ট চালু হওয়ার পরও অনুদান আসে চূড়ান্ত অনিয়মিত ভাবে। অথচ টাকা না এলে এই প্রকল্পের যাবতীয় খরচ (ফেলোশিপ সমেত) বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যায়ও। তার পর কাজের জায়গাতেও তাঁর অবস্থানটা এক জন গোটাগুটি বিজ্ঞানীর মতো না হয়ে মেন্টর বিজ্ঞানীর অধীন একটু অভিজ্ঞ এক জন গবেষকের মতোই হয়ে দাঁড়ায়। কাজের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই মেয়েটিকে পদে পদে তাঁর মেন্টরের অনুমতি নিয়ে চলতে হয়, ফলে তাঁর স্বাধীন ভাবে কাজ করার সুযোগ কমে যায়। এর বিরোধিতা করতে গেলে নানারকম অসুবিধা ঘটে ল্যাবরেটরির কাজে, কারণ পরীক্ষামূলক গবেষণার কাজ একা একা কিছুতেই ভাল করে করা যায় না। তাই মহিলা বিজ্ঞানীটিও মেন্টরের খুব বেশি বিরোধিতা করতে পারেন না। ডি এস টি মেন্টরের অবস্থান বা অন্যান্য নিয়মকানুন কিছুতেই পরিষ্কার করে জানায় না, কিন্তু দাবি করে মহিলাটি নিজের দায়িত্ব ও অধিকার বিষয়ে সচেতন থাকবেন, একাই সব কাজ করবেন আর ন্যূনতম সময়ে ফলাফল প্রকাশ করেও ফেলবেন। যাঁরা গবেষণার সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা বুঝবেন ব্যাপারটা কত কঠিন।

কিন্তু এই কঠিন কাজ কোনও ভাবে করে ফেললেও তার কোনও স্বীকৃতি নেই। একটা প্রজেক্ট ভাল ভাবে শেষ করতে পারলে মেয়েটি যে পরে আবার একটা প্রজেক্ট পাবেনই, তার কোনও স্থিরতা নেই। আর মেয়েটি যদি কোনও বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণাকেন্দ্রে চাকরির জন্য আবেদন করেন (যেখানে গবেষণা করা সম্ভব), সেখানেও ‘বিজ্ঞানী হিসেবে’ এই তিন বছরের অভিজ্ঞতা কোনও বিশেষ মূল্য নেই। তাই ‘ডি এস টি-তে মেয়েদের জন্য অনেক ব্যবস্থা আছে’, এই রকম ভাসা-ভাসা কথা অনেকেই জানেন, কিন্তু কাজের কাজ কতটা হয়, তা এমনকী সরাসরি এই পেশার লোকজনও ঠিকমত জানেন না। যার ফল হল, ‘মহিলা বিজ্ঞানী’ হিসেবে তিন (বা ছয়) বছর কাজ করার পরও আসলে মেয়েরা পেশাদার গবেষণার ক্ষেত্রে পিছিয়েই যাচ্ছেন। গবেষণা ছেড়ে ইস্কুল-কলেজে পড়াচ্ছেন বা অন্য কিছু করছেন। অর্থাৎ, মেয়েদের গবেষণায় ফিরিয়ে আনার যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই পরিকল্পনা করা, সেটা নষ্টই হচ্ছে।

ডি এস টি-র কার্যক্রমে পরিষ্কার লেখা আছে, সংসারে হারিয়ে যাওয়া নারী-মেধাশক্তিকে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে আর বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে এই বিরাট সংখ্যক নারী-মেধার অপচয় রুখতেই এই পরিকল্পনা। কিন্তু ডি এস টি নিজেই যদি এই পরিকল্পনাকে যথেষ্ট গুরুত্ব না দেয়, এর পরিচালনা এবং মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এতটা উদাসীন থাকে, তবে বৃহত্তর সমাজে এর গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা পাবে কী করে! এই প্রকল্পের বার্ষিক হিসেবের পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায়, গত দু’বছরে এই খাতে মঞ্জুর হওয়া প্রজেক্টের সংখ্যা ক্রমাগত কমেছে। সরকারের কাছে মেয়েদের গবেষণায় ফিরিয়ে আনার গুরুত্ব কমছে, মেয়েরা ‘পুনর্মূষিকো ভব’ হয়ে পড়ছেন।

এই লেখা পড়তে পড়তে অনেকেই ভাবছেন— সংসার করতে করতে মেয়ে হিসেবে সুবিধেও নেবে, আবার বিজ্ঞানীও হবে— এ হয় না বাছা! আসল কথা, বছর বছর এই মরসুমে নারীশক্তির যতই ঢাক পিটানো হোক, মহিলা বিজ্ঞানীরা ভাল নেই, এই দেশে তাঁদের ভাল থাকার কথাও নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE