Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
স্বামী বিবেকানন্দের কথা তাঁর নিজের মুখে শোনাই ভাল

আমার পথ আমার পক্ষে ঠিক কিন্তু তোমার পক্ষে নহে

বইটি কোনও একটি সময়ে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের একটি প্রতিষ্ঠান আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমি উপহার হিসেবে পেয়েছিলাম। আমি বক্তৃতাটির যে অংশ যে বিষয় সম্পর্কিত, সেই বিষয় অনুযায়ী বক্তব্যগুলোকে সাজানোর চেষ্টা করব।

সুগত মারজিৎ
শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৭ ১৩:০০
Share: Save:

স্বামী বিবেকানন্দের মতামত, আলোচনা, বক্তৃতা যুগোত্তীর্ণ উপাদান। আজ আমরা রাজনীতির এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে ধর্ম, সম্প্রদায়, রাজনীতি সব কিছুকে জড়িয়ে নতুন মূল্যায়ন, বিতর্ক, ক্ষোভ ইত্যাদির সম্মুখীন আমরা। জাতীয় এবং আঞ্চলিক স্তরে রাজনীতির বিভিন্ন দলের শীর্ষে থাকা অনেকে, যাঁরা ভারতের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছেন তেমন সব মানুষ স্বামী বিবেকানন্দকে আদর্শ বলে মানছেন। তাই আমার মনে হয় স্বামীজির অনেক কথা এখন প্রাসঙ্গিক। তাঁর একটি বক্তৃতার কথা আজ উল্লেখ করব। কারণ, সেখানে অনেক জায়গায় তিনি যা বলেছেন, তা আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণে নিঃসন্দেহে খানিকটা সহায়ক হবে। বিশেষ করে ভারতে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু জড়িত চিরন্তন চাপান-উতোর সম্পর্কে জনমত গঠনে সাহায্য করবে।

১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি আমেরিকা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর স্বামীজি জাফনায় (বর্তমান শ্রীলঙ্কার অন্তর্গত) বেদান্ত নিয়ে একটি বক্তৃতা দেন। আমি সেই বক্তৃতার কিছু কিছু অংশ উদ্ধৃত করব। বক্তৃতাটি কলকাতার উদ্বোধন কার্যালয় থেকে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ভারতে বিবেকানন্দ নামক গ্রন্থটি থেকে নেওয়া হয়েছে। বইটি কোনও একটি সময়ে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের একটি প্রতিষ্ঠান আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমি উপহার হিসেবে পেয়েছিলাম। আমি বক্তৃতাটির যে অংশ যে বিষয় সম্পর্কিত, সেই বিষয় অনুযায়ী বক্তব্যগুলোকে সাজানোর চেষ্টা করব।

হিন্দু শব্দটি প্রসঙ্গে:

‘‘যে হিন্দু নামে পরিচয় দেওয়া এখন আমাদের প্রথা হইয়া দাঁড়াইয়াছে তাহার কিন্তু আর কোন সার্থকতা নাই। কারণ ঐ শব্দের অর্থ— যাহারা সিন্ধুনদের ওপারে বাস করিত। প্রাচীন পারসীকদের বিকৃত উচ্চারণে ‘সিন্ধু’ শব্দই ‘হিন্দু’রূপে পরিণত হয়, তাঁহারা সিন্ধুনদের অপর তীর-বাসী সকলকেই হিন্দু বলিতেন। এইরূপেই ‘হিন্দু’ শব্দ আমাদের নিকট আসিয়াছে। মুসলমান-শাসনকাল হইতে আমরা ঐ শব্দ নিজেদের উপর প্রয়োগ করিতে আরম্ভ করিয়াছি। এই শব্দ ব্যবহারে কোন ক্ষতি না। কিন্তু পূর্বেই বলিয়াছি, এখন ইহার সার্থকতা নাই। কারণ তোমরা বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করিও যে বর্তমানকালে সিন্ধুনদের এই দিকে সকলে আর প্রাচীনকালের মত এক ধর্ম মানেন না। সুতরাং ঐ শব্দে শুধু খাঁটি হিন্দু বোঝায় না, উহাতে মুসলমান, খ্রীষ্টান, জৈন এবং ভারতের অন্যান্য অধিবাসিগণকেও বুঝাইয়া থাকে।’’ (পৃ ১১)

সমাজের পরিবর্তন এবং ধর্মাচার প্রসঙ্গে:

‘‘যে সকল ধর্মকার্য আমাদের সামাজিক অবস্থা ও সম্বন্ধের উপর নির্ভর করে সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সেইগুলিও পরিবর্তিত হইয়া যাবে। সুতরাং সময় বিশেষে কোন বিশেষ বিধিই সত্য ও ফলপ্রদ হইবে, অপর সময় নহে। তাই আমরা দেখিতে পাই, কোন সময়ে কোন খাদ্য-বিশেষের বিধান রহিয়াছে, অন্য সময়ে তাহা আবার নিষিদ্ধ। সেই খাদ্য সেই সময়-বিশেষের উপযোগী ছিল, কিন্তু ঋতু পরিবর্তন ও অন্যান্য কারণে উহা তৎকালের অনুপযোগী হওয়ায় স্মৃতি তখন ঐ খাদ্য ব্যবহার নিষেধ করিয়াছেন। এই কারণে স্বভাবতই প্রতীত হইতেছে যে, যদি বর্তমানকালে আমাদের সমাজের কোন পরিবর্তন আবশ্যক হয় তবে ঐ পরিবর্তন করিতেই হইবে।’’ (পৃ ১৩)

সাম্প্রদায়িক বৈচিত্র প্রসঙ্গে:

‘‘সকলকেই এক পথে যাইতে হইবে— এ কথার কোন অর্থ নাই, ইহাতে বরং ক্ষতিই হইয়া থাকে। সুতরাং সকলকে এক পথ দিয়া লইয়া যাইবার চেষ্টা একেবারে পরিত্যাজ্য। যদি কখনও পৃথিবীর সব লোক এক ধর্মমতাবলম্বী হইয়া এক পথে চলে, তবে বড়ই দুঃখের বিষয় বলিতে হইবে। তাহা হইলে লোকের স্বাধীন চিন্তাশক্তি ও প্রকৃত ধর্মভাব একেবারে বিলুপ্ত হইবে। বৈচিত্র্যই আমাদের জীবনযাত্রার মূলমন্ত্র। বৈচিত্র্য সম্পূর্ণরূপে চলিয়া গেলে সৃষ্টিও লোপ পাইবে। যতদিন চিন্তাপ্রণালীর এই বিভিন্নতা থাকিবে, ততদিন আমাদের ব্যক্তিগত অস্তিত্ব থাকিবে। বৈচিত্র্য আছে বসিয়াই বিরোধের প্রয়োজন নাই। তোমার মত তোমার পক্ষে ভাল বটে, কিন্তু আমার পক্ষে নহে। আমার পথ আমার পক্ষে ঠিক কিন্তু তোমার পক্ষে নহে, প্রত্যেকের ইষ্ট ভিন্ন এই কথায় এই বুঝায় যে, প্রত্যেকের পথ ভিন্ন। এটি মনে করিও কোন ধর্মের সহিত আমাদের বিবাদ নাই। আমাদের প্রত্যেকেরই ইষ্ট ভিন্ন। যাহারা ঈশ্বরলাভের উদ্দেশ্যে ভিন্ন পথাবিলম্বী ভ্রাতাদের বিনাশ-সাধন করিতে ইচ্ছুক। তাহাদের মুখে প্রেমের কথা বড়ই অসঙ্গত ও অশোভন। তাহাদের প্রেমের বিশেষ কিছু মূল্য নাই। অপরে অন্য পথের অনুসরণ করিতেছে, ইহা যে সহ্য করিতে পারে না, সে আবার প্রেমের কথা বলে? তবে দ্বেষ বলিব কাহাকে? খ্রীষ্ট, বুদ্ধ বা মহম্মদ জগতের যে কোন অবতারেরই উপাসনা করুক না কেন, কোন ধর্মাবলম্বীর সহিত আমাদের বিবাদ নাই। হিন্দু বলেন ‘এস ভাই, তোমার যে সাহায্য আবশ্যক, তাহা আমি করিতেছি। কিন্তু আমি আমার পথে চলিব, তাহাতে কিছু বাধা দিও না। তোমার পথ খুব ভাল, তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু আমার পক্ষে উহাতে ঘোরতর অনিষ্ট করিতে পারে।’’ (পৃ ২২)

ঈর্ষা ও আদেশ দেওয়ার প্রবণতা প্রসঙ্গে:

‘‘সর্বোপরি আমাদিগকে একটি বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি রাখিতে হইবে। শত শত শতাব্দী ধরিয়া আমরা ঘোরতর ঈর্ষাবিষে জর্জরিত হইতেছি— আমরা সর্বদাই পরস্পরকে হিংসা করিতেছি। অমুক কেন আমা অপেক্ষা বড় হইল। আমি কেন তাহা অপেক্ষা বড় হইলাম না— অহরহ আমাদের এই চিন্তা। এমন কি ধর্মকর্মেও আমরা এই শ্রেষ্ঠত্বের অভিলাষী আমরা এমন ঈর্ষার দাস হইয়াছি। ইহা ত্যাগ করিতে হইবে।... সর্বদা দাস হইতে শিক্ষা কর, তবেই প্রভু হইতে পারিবে।’’ (পৃ ২৪)

স্বামী বিবেকানন্দ আমাদের ঘরের কাছের লোক। এ চত্বরেই নরেন্দ্রনাথ দত্তের উত্তরণের ব্যবস্থা করেছিলেন যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ এবং পরে সর্বজননী মা সারদা। পরদর্শন, পরচেতনা এবং পরধর্ম সহিষ্ণুতার এক অপূর্ব পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে কলকাতার অদূরেই। হিন্দুধর্মে আধুনিকতার শিক্ষা নিঃসন্দেহে দেশ ও সমাজ গঠনের কাজে রাজনীতির মানুষজন গ্রহণ করবেন, এটাই স্বাভাবিক। স্বাধীন ভারতে বহু দিন কেন্দ্রীয় স্তরে এবং বিশেষ করে এই রাজ্যে এ ব্যাপারে তেমন সচেতনতা দেখা যায়নি। আজ এই রাজ্যে এবং কেন্দ্রে সময়টা পালটেছে। কিন্তু রাজনীতির একটা চরিত্র হল, যা কিছু বা যে জন অতীব জনপ্রিয় তাকেই নিজের দলে টানা ও রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানো। কিন্তু সময়ে সময়ে মহাজ্ঞানী মহাজন ঠিক কী বলতে চেয়েছেন, তাঁরা কতটা প্রাসঙ্গিক, সরাসরি ঝালিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হয়। তাঁদের কথার কতটা মানুষ নেবেন, কতটা নেবেন না, সেটা ব্যক্তিগত স্তরে বিচার্য বিষয়। কিন্তু তাঁদের জীবন এবং আদর্শের সঙ্গে মানুষের প্রত্যক্ষ পরিচিতি প্রয়োজন।

সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা’য় অর্থনীতির শিক্ষক

ছবি: সুব্রত চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Swami Vivekananda
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE