Advertisement
১৭ মে ২০২৪
প্রবন্ধ

ইচ্ছে হয়েছে, থাবড়েছি

স ভ্যতার হরেক ফ্যাচাংয়ের মধ্যে প্রধানতম, নিজের প্রতি চূড়ান্ত সৎ থাকার অধিকারটাকে গোড়াতেই বিসর্জন দিতে হয়। যে সহকর্মীর গালে সপাট একটা থাপ্পড় কষাতে ইচ্ছে করে, তার সঙ্গেও দাঁত বের করে হাসতে হয়, বাড়িতে শাশুড়ি এলে বাজার থেকে কিনে আনতে হয় চুনোমাছ, বন্ধুর স্ত্রীর দিকে হালকা ইয়ার্কির বেশি এগোতে হয় না।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৭ ০০:৩৭
Share: Save:

স ভ্যতার হরেক ফ্যাচাংয়ের মধ্যে প্রধানতম, নিজের প্রতি চূড়ান্ত সৎ থাকার অধিকারটাকে গোড়াতেই বিসর্জন দিতে হয়। যে সহকর্মীর গালে সপাট একটা থাপ্পড় কষাতে ইচ্ছে করে, তার সঙ্গেও দাঁত বের করে হাসতে হয়, বাড়িতে শাশুড়ি এলে বাজার থেকে কিনে আনতে হয় চুনোমাছ, বন্ধুর স্ত্রীর দিকে হালকা ইয়ার্কির বেশি এগোতে হয় না। আর, প্রতিটা মুহূর্ত যদি বাঁচতে হয় অজস্র নিষ্পলক চোখের সামনে, চব্বিশ ঘণ্টার ব্রেকিং নিউজ-এর শিরোনাম হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে? অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের শত্রু বলে দেওয়ার পরও বিরাট কোহালিকে ঢোঁক গিলতে হয় পরের দিন। যিনি নিজের প্রতি তুমুল সৎ থাকতে পারেন, সামাজিক সমঝোতার তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছেগুলোকে নির্দ্বিধায় পরিণত করে ফেলতে পারেন কাজে, তাঁর কি একটা আন্তরিক কুর্নিশ প্রাপ্য হয় না?

আসুন, যোগী আদিত্যনাথকে তাঁর পাওনা সম্মানটুকু দিই। মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে ঠিক মতো বসার সময়টুকুও পাননি, তার মধ্যে মোক্ষম দুই থাবড়া কষিয়ে দিয়েছেন সমাজের যাবতীয় সুশীলপনার তুলতুলে গালে। কোনও ভ্যানতাড়া, কোনও অজুহাত ছাড়া। স্রেফ ইচ্ছে হয়েছে বলে বন্ধ করে দিয়েছেন সমস্ত কসাইখানা। রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছেন অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড। জোড়া ছেলেমেয়ে দেখলেই কান ধরে ওঠবস। ত্যান্ডাইম্যান্ডাই করলে মাথা কামিয়ে ছেড়ে দেওয়া। নাগরিক অধিকার? নিজের রুচিতে খাওয়ার অধিকার, পছন্দের সঙ্গীর সঙ্গে সময় কাটানোর অধিকার? জাস্ট ইচ্ছে হয়নি বলে প্রশ্নগুলোর কোনও উত্তরই দিলেন না যোগী।

বলতে অনেক কিছুই পারতেন। সবচেয়ে জোরে বলতে পারতেন যে কথাটা, সেটা হল, কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, ক্ষমতা সেটা স্থির করে দেবে। গোটা দুনিয়ায় ছেলেমেয়েরা হাত ধরে বেলেল্লার মতো ঘুরে বেড়ায় বলেই সেটা উত্তরপ্রদেশেও ঠিক, কার বাপের সাধ্যি সেই দাবি করে! বলতে পারতেন, যখন শ্রীরাম সেনে-র অফিসে ঝুড়ি ঝুড়ি পিঙ্ক চাড্ডি পাঠিয়েছিল সবাই, তখন ভাবা উচিত ছিল, দিন বদলাবে। এমন কী-ই বা বলেছিল সেই গেরুয়া ঝান্ডাধারীর দল? বলেছিল, ভ্যালেন্টাইনস ডে-র দিন একসঙ্গে দেখা গেলেই ধরে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে। তখন হাতে ক্ষমতা ছিল না। এখন ৩৬৫ দিনই ভ্যালেন্টাইনস ডে। নে, এ বার পাঠা পিঙ্ক চাড্ডি। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক খালি হয়ে যাবে, চাড্ডি পাঠিয়ে দিশে করতে পারবি না। গোকুলে যারা বেড়েছে, তোমাকে তারা বধিবেই— মারে রামলালা, রাখে কে?

আদিত্যনাথ বলতে পারতেন, কোনটা ভারতীয় সংস্কৃতি, দ্বাপরযুগে সরযূ নদীর তীরে যিনি জন্মেছিলেন, তাঁরটা, নাকি ত্রেতায় গোকুলে বেড়ে ওঠা যুগপুরুষেরটা— সেটাও ক্ষমতাই ঠিক করে দেবে। সন্দেহ হয়, রাধার সঙ্গে প্রেম আর গোপিনীদের সঙ্গে খুনসুটির বহর দেখলে গোকুলের ভদ্রলোককেও ছেড়ে কথা বলত না অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড। অথবা, খুনসুটি নিয়ে মাথা ঘামাত না মোটেও, নদীর ধার থেকে পোশাক নিয়ে পালিয়ে যাওয়াতেও আপত্তি করত না— আরও বড় প্রশ্নেও যেমন আপত্তি করেননি আদিত্যনাথ। দেশের মধ্যে মেয়েদের দিকে সবচেয়ে বেশি অ্যাসিড ছোড়ার ঘটনা ঘটে উত্তরপ্রদেশেই, আদিত্যনাথ মুখ খোলেননি তা নিয়ে। কেন, সে উত্তরও তিনি সম্ভবত দেবেন না। তবে, আঁচ করা যায়— আপত্তিকর কিছু চোখে ঠেকেনি বলেই আপত্তি করেননি তিনি।

লোকে অ্যাসিড ছোড়ে কেন, সে তো জানা কথা— প্রেমপ্রস্তাব পাঠিয়ে ব্যর্থ হলে। ছেলেরা জোয়ান হলে প্রেম করতে চাইবে, নারী শরীর ভোগ করতে চাইবে, তাতে আপত্তি করে কোন আহাম্মক? মেয়েরা পুরুষের কাঙ্ক্ষিতা হবে, পুরুষের ইচ্ছেয় হ্যাঁ বললে বিয়ের পর ঘরে উঠবে, আর সেই ইচ্ছায় অসম্মত হলে ধর্ষিতা হবে অথবা অ্যাসিডে পুড়ে যাবে মুখ— এই অবধি তো ঠিকই আছে। আপত্তি আসলে মেয়েদের প্রেম করতে চাওয়ায়। তাদের সমানে সমানে রাস্তায় বেড়িয়ে পড়ায়। বোরখার কনসেপ্টটা অনেক আগেই ছিনতাই হয়ে যাওয়ায় গেরুয়াবাহিনীর ভারী সমস্যা হয়েছে। নয়তো, কে বলতে পারে, ওই পোশাকটাও হয়তো সনাতন ভারতীয়ত্বের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হত।

মেয়েরা নিজেদের ‘অওকাতে’ থাকুক, এমন ইচ্ছে আদিত্যনাথের একার, বললে বাকি নেতাদের প্রতি ভারী অন্যায় হবে। শুধু তাঁর দলের নেতাদের প্রতি নয়, শুধু গৈরিকবর্ণের নেতাদের প্রতি নয়, মুলায়ম সিংহ যাদব থেকে শরদ যাদব হয়ে মদন মিত্র, হরেক দলের হরেক মাপের নেতার মনে অক্ষয় হয়ে আছে এমনই এক সনাতন ভারতের ছবি। ফারাক হল, আদিত্যনাথের সাহস আছে নিজের প্রতি সৎ থাকার, বাকিদের নেই। এই সততার তুলনা হতে পারে তালিবানরা, বোকো হারাম বা আইসিসের নেতারা। আদিত্যনাথের কৃতিত্ব, তিনি মনের বাসনার সঙ্গে সমঝোতা করেননি। মনে করেছেন, মেয়েদের পথেঘাটে স্বাধীন ঘোরাফেরার প্রয়োজন নেই, পরপুরুষের সঙ্গে তো নয়ই— এবং, সেই মনে করাটাকে সম্মান করেছেন। রাজনীতির মেকি সভ্যতা তাঁকে বন্দি করতে পারেনি। রাজনীতিতে তিনি খানিক বহিরাগত বলেই হয়তো।

আরও পড়ুন: আগামী সপ্তাহেই হয়তো কালবৈশাখী

অস্বীকার করার উপায় নেই, নেতা এমন সমঝোতাহীন সৎ হলে একটা মুক্তির আনন্দ হয়। অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি। এখানে ভাবতে হয় না, বিগ ব্রাদার আড়াল থেকে নজর রাখছে কি না। ফেসবুকে শেয়ার করা কোনও অকিঞ্চিৎকর জোক আমায় পৌঁছে দিতে পারে কি না পুলিশের দোরগোড়ায়। চিন্তা করতে হয় না, আধার কার্ডের তথ্য থেকে তৈরি করা হচ্ছে কি না ডেমোগ্রাফিক প্রোফাইল, যা দিয়ে বুঝে নেওয়া যাবে, ঠিক কোন চত্বরে কত জন মুসলমান থাকেন। অথবা, নেতা তাঁর ভাষণে কবরস্থান আর শ্মশানের তুলনা করে যাওয়ার কত দিন পরে দাঙ্গা হবে, সেই চিন্তায় থাকতে হয় না। আড় চোখে দেখে নিতে হয় না, ‘এক দেশ, এক সংবিধান’-এর আপাত-নিরীহ স্লোগান থেকে কী ভাবে মুখ বাড়ায় মুসলমানদের আরও এক দফা কোণঠাসা করে দেওয়ার ছক। আদিত্যনাথের দুনিয়া আলাদা। সেখানে অনুমান করার দরকার নেই। বরং, আগেভাগে জানা থাকে, কোন পথে হাঁটলে বিপদ আসবেই। হয়তো আরও কিছু দিন পরে জানা যাবে, মাথায় ফেজ টুপি থাকলে, গালে বিশেষ রকমের দাড়ি থাকলে আরও কোনও এক স্কোয়াডের সদস্যরা এসে ভারতীয় সংস্কৃতির মাহাত্ম্য বুঝিয়ে যাবে। কিন্তু, মুসলমান খেদানোর জন্য বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর দোহাই দেওয়ার প্রয়োজন হবে না।

পুনশ্চ: তবুও, ভুল কি আর হয় না? অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াডও প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল ধরার উত্তেজনায় এক জোড়া ভাইবোনকে ধরে কান মুলে দিয়েছে। তবে, ওই যে শাহরুখ খান বলে গিয়েছেন, ‘বড়ি বড়ি দেশোঁমে এইসি ছোটি ছোটি গলতি’ ইত্যাদি। বিপ্লব হলে কোল্যাটারাল ড্যামেজও হয়— সব কিছু নিয়ে অত ভাবলে চলে না। তা ছাড়াও, ওই ভাইবোনের আক্কেলটা ভাবুন। দেখছে শহর জুড়ে ভারতীয় সংস্কৃতি শেখানো হচ্ছে, তার মধ্যে ড্যাংড্যাং করে বেড়িয়ে পড়ল! আর, খুব সম্ভবত ভাইবোনের ব্যাপারটা স্কোয়াডের মাথাতেও আসেনি। উত্তরপ্রদেশ তো— বাড়িতে ভাই থাকলে আবার বোন আসে কোত্থেকে, স্কোয়াডের ভাইয়ারা ভেবেই পায়নি। ‘বেটি বচাও’ স্লোগান তো মাত্র তিন বছর হল— তার মধ্যেই যদি বেটি এত বড় হয়ে যায়, সেটা কি ভাইয়াদের দোষ?

শিল্পী: কুনাল বর্মণ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Anti romeo squad Yogi Adityanath UP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE