Advertisement
১৮ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ৩

অস্ত্র উদ্ধার ছাড়া অন্য পথ নেই যে ভাবে ঘরে ঘরে

অস্ত্র ঢুকে গেছে, তার থেকে বেরোবার একমাত্র রাস্তা জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্র জমা নেওয়া। লিখছেন বোলান গঙ্গোপাধ্যায়।বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে আবার সেই দৃশ্যাবলির পুনরাবৃত্তি। চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ধানখেতে পড়ে থাকা মৃতদেহ, কুঁড়েঘরের সামনে বন্দুক ছুড়ছে পুলিশ। ধানখেতের আল ধরে বন্দুকধারী পুলিশের মিছিল। অঘোষিত এক যুদ্ধ পরিস্থিতির খুব চেনা পশ্চিমবঙ্গ।

শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে আবার সেই দৃশ্যাবলির পুনরাবৃত্তি। চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ধানখেতে পড়ে থাকা মৃতদেহ, কুঁড়েঘরের সামনে বন্দুক ছুড়ছে পুলিশ। ধানখেতের আল ধরে বন্দুকধারী পুলিশের মিছিল। অঘোষিত এক যুদ্ধ পরিস্থিতির খুব চেনা পশ্চিমবঙ্গ। রাজনৈতিক দলের দড়ি টানাটানির মাঝে পড়ে অসহায় মানুষের গুলিবিদ্ধ হওয়া আর দল বদল করে বাঁচার মরিয়া চেষ্টা।

অবস্থা এখন এমন এক পর্যায়ে গেছে যে, দিন-আনি-দিন-খাই মানুষের আর কোনও নিরাপত্তা নেই। যখন যে দল সিংহাসনে, প্রশাসন তার পায়ে মাথা মুড়িয়ে রেখেছে নিজের নিরাপত্তার কারণে। আইনের দরজা পর্যন্ত পৌঁছনো এত সময় আর ব্যয়সাপেক্ষ যে, হা-অন্ন ঘরে সে কথা ভাবার আগেও ভাবতে হয়, ভাবব কি না! তা ছাড়া, দৈনন্দিন জীবনে আইন এসে বাঁচায় না। আর তাই একমাত্র আশা যে রাজনৈতিক দল বাঁচাবে। এ দল মারলে ওই দল বাঁচাবে।

বাঁচানোর অর্থ এখন দাঁড়িয়েছে: দল হাতে অস্ত্র দেবে, আর সেই দলের পাঁচ জন অস্ত্র-হাতে বিপক্ষ দলের অস্ত্রের মোকাবিলা করবে। আর তাই, শুধুমাত্র দিনগত বেঁচে থাকার জন্যই গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে এমন অস্ত্র।

সেই অস্ত্র কিন্তু আসলে কাউকেই নিরাপত্তা দিতে পারেনি। প্রতিদিনের জীবন তাই কেবল অনিশ্চিত নয়, বিপদসঙ্কুলও হয়ে উঠেছে। কখন কার গুলি এসে বুকে লাগবে, কেউ জানে না। এই অস্ত্রের পিছনে কোনও তত্ত্ব বা মতাদর্শ কাজ করছে না। গরিব মানুষের অস্ত্রের নিশানা প্রতিবেশী গরিব মানুষ। ভয়ঙ্কর এই খেলার পরিণতি ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।

এই রকম অবস্থায় যখনই গ্রামবাসীদের প্রশ্ন করেছি, ‘আপনাদের সঙ্গে কি ওঁদের কোনও শত্রুতা ছিল?’ উত্তর পেয়েছি, ‘না, সে সব কিছু না। ওই অন্য পার্টি।’ মাখড়ায় আক্রান্ত বাড়িতে জিজ্ঞাসা করেছি, ‘আপনাদের বাড়ি আক্রমণ করল কেন?’ সমস্বরে উত্তর পেয়েছি, ‘আমরা যে আর তৃণমূল নেই। তাই...’ অন্য দল হলে মেরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াই এখন পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। যদি কেউ দল বদলাতে চায়, তা হলেও তাকে গুলি-বোমার সাহায্যেই ‘শিক্ষা’ দিতে দবে। এই একটা ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলই সহমত পোষণ করে।

দুই মেদিনীপুরেই, নন্দীগ্রাম পর্বে চোদ্দো-পনেরো বছরের ছেলেদের হাতে অস্ত্র দেখেছি নিজের চোখে। দেখতে দেখতে কোনও জেলাই আর অস্ত্র সংগ্রহে পিছিয়ে নেই। এতকাল জানতাম, অস্ত্র নিয়ে দলাদলি করে কিছু সমাজবিরোধী। এখন সেই ভেদাভেদ ঘুচে গিয়ে ‘সকলের জন্য অস্ত্র’। বীরভূমেই নিষ্ক্রিয় প্রশাসন আর দলাদলির কথা শুনতে শুনতে প্রশ্ন করেছিলাম ‘কিন্তু দল বদলালেই বাঁচবে? কী করে?’ ফ্রক-পরা এক বালিকা উত্তর দেয়, ‘কেন? মেশিন দেবে।’ মনে পড়ে, একদিন ঠিক এই ভাবে সিপিএমের হাত থেকে বাঁচতে তৃণমূলের অস্ত্র হাতে তুলে নিতে দেখেছি নন্দীগ্রাম অঞ্চলে।

যে ভাবে গত নয়-দশ বছর ধরে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে অস্ত্র ঢুকে গেছে, তার থেকে বেরোবার একমাত্র রাস্তা বোধহয় জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্র জমা নেওয়ার ব্যবস্থা করা। রাজ্যপালও এ বিষয়ে সদর্থক ভূমিকা নিতে পারেন। ভূমিকা নিতে পারেন দেশের বিবেকস্বরূপ বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মীরা। যদি সত্যি-সত্যি সমস্ত দলকে, বিশেষ করে শাসক দলকে (কারণ তার অঙ্গুলি হেলনে প্রশাসন নড়ে চড়ে) প্রশাসন অস্ত্র জমা দিতে বাধ্য করতে পারে, তা হলেই এই অনর্থক মৃত্যু আর আতঙ্কিত দিন-রাত্রি থেকে হয়তো গ্রামবাংলার মানুষ পরিত্রাণ পাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial bolan gangopadhay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE