ধর্মান্তর, কিংবা পুনঃ-ধর্মান্তর, এই সকল প্রক্রিয়াই যে শেষ বিচারে ব্যক্তির অধিকার, রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক চাপের বিষয় নয়, এই সাধারণ কথাটি এ দেশের সমাজে সাধারণত অস্বীকৃত। ইতিহাস ঘাঁটিয়া যে প্রমাণই বাহির করা হউক না কেন, পুরাতন দেশের কথা বাদ দিয়া স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের কথা যদি ভাবি, তবে ধর্ম নির্বাচন ও ধর্ম পালনের অধিকার একটি মৌলিক অধিকারই বটে। অর্থাৎ তাহা ব্যক্তি-নাগরিকের অধিকার। তাহাতে যদি কোনও ধর্ম-সম্প্রদায় সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল হইয়া পড়ে, তবে তাহাই ভবিতব্য, নিজেকে পুনর্বিবেচনা করিবার সুযোগ। একটিই নীতি এ ক্ষেত্রে পালনীয় হইতে পারে, তাহা হইল, ধর্মের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বলপ্রয়োগ ‘না’ করিবার নীতি। উল্লেখযোগ্য যে, কিছু ব্যতিক্রমী মুহূর্ত বাদ দিয়া এ দেশের ইতিহাসে কিন্তু মোটের উপর স্বাধীন ধর্ম-নির্বাচনের প্রক্রিয়াই জারি থাকিয়াছে। দারিদ্র ও সামাজিক অত্যাচারের সামনে ইসলামে ধর্মান্তরই এ দেশের প্রধান ধারা। অতীতেও। বর্তমানেও। সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশের মেরঠ জেলার মোগা গ্রামের এক দলিত শ্যাম সিংহের ঘটনাটি আবার দেখাইয়া দিল, কী ভাবে সেই ট্র্যাডিশন আজও চলিতেছে। বাল্মীকি সম্প্রদায়ভুক্ত এই দলিত বাগপত জেলার একটি মন্দিরে পূজা দিতে গেলে পূজারি ও মন্দির কর্তৃপক্ষ তাঁহাকে খেদাইয়া দেয়। জেলাশাসকের কাছে, জাতীয় তফশিলি জাতি-উপজাতি কমিশনের কাছে এবং শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দফতরেও ওই মন্দিরে পূজার্চনার অধিকার দাবি করিয়া আবেদন জানাইয়াও কোনও উত্তর না পাইয়া তিনি সপরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁহার যুক্তিযদি হিন্দু হইয়া জন্মিয়াও হিন্দু মন্দিরে উপাসনার অধিকার তাঁহার না থাকে, তবে ইসলাম গ্রহণ করাই শ্রেয়।
শ্যাম সিংহের ঘটনাটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ইহা দেখাইয়া দেয়, কেন বিগত হাজার বছর ধরিয়া দলিত-অনুসূচিত সম্প্রদায়ের হিন্দুরা জাতিভেদপ্রথার বৈষম্য, বঞ্চনা ও অসম্মান সহ্য করিতে না পারিয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। একই ভাবে খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগে উপজাতি অর্থাৎ অরণ্যচারী জনজাতিগুলির বৃহদংশই ধর্মান্তরিত হন। সেই তালিকায় যেমন মধ্য ভারতের বিভিন্ন জনজাতি ছিল, তেমনই ছিল সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতের মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠীভুক্ত জনজাতিগুলি। হিন্দুত্ববাদীদের প্রচার: অর্থের প্রলোভন দেখাইয়া কিংবা স্রেফ শাসকের রক্তচক্ষুতে এই ধর্মান্তর ঘটানো হইয়াছে। তাঁহারা ভুলিয়া যান, প্রলোভন এবং বলপ্রয়োগ কিন্তু এক কথা নয়। দু-এর মধ্যে সীমারেখাটি সূক্ষ্ম হইলেও পার্থক্যটি গুরুতর। প্রথমটি স্বাভাবিক, দ্বিতীয়টি অন্যায়। অতীতেও তাহা অন্যায় ছিল। বর্তমানেও তাই।
শ্যাম সিংহকে আপাতত জেলা-প্রশাসন শান্তিভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করিয়াছে। ওই গ্রামে বসবাসও হয়তো ছাড়িতে হইবে। ঘটনাটি এমন সময় ঘটিতেছে, যখন সঙ্ঘ পরিবার ধর্মান্তরিত হিন্দুদের ঘরে ফিরাইতে ‘ঘর-ওয়াপসি’ যজ্ঞের আয়োজনে ব্যস্ত, রকমারি উৎকোচ ও নগদ-বিদায়ের বন্দোবস্ত-সহ। কোথাও রেশন কার্ড, আধার কার্ড, কোথাও চাল-ডাল-তেল, নগদ অর্থ। আবারও সেই প্রলোভন ও বলপ্রয়োগের দ্বৈত বাস্তব। প্রলোভন একটি সামাজিক পদ্ধতি, তাহার প্রেক্ষিতেই ব্যক্তির নিজস্ব অধিকারটি নির্মিত হয়। কিন্তু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নির্যাতন থাকিলে যে ফল শেষে বিপরীত দাঁড়াইবে, শ্যাম সিংহের ঘটনাটিই দেখাইয়া দেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy