Advertisement
১৮ মে ২০২৪
West Bengal Assembly Election 2021

মানস ভুঁইয়া । সবং

আনন্দবাজার ডিজিটাল
শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২১ ১৯:৫২
Share: Save:

এবং সবং: ধাম দিয়ে নাম চেনা। প্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায় তো ‘সবং ভুঁইয়া’ বলেই ডাকতেন। রাজ্যসভায় চলে গেলেও গিন্নি গীতার হাতে রেখে গিয়েছিলেন সবং বিধানসভা। মেদিনীপুরে লোকসভা নির্বাচনে হারের পর ফিরেছেন নিজ-ভূমে। এখনও রয়েছেন রাজ্যসভায়। ফলে নীলবাড়ির লড়াইয়ে হারানোর কিছু নেই। জয় করার জন্য আছে রাজ্যের মন্ত্রিত্ব। প্রথম মমতা মন্ত্রিসভায় পেয়েছিলেন বটে। কিন্তু কয়েক মাসের বেশি স্থায়ী হয়নি।

গীতা-সহায়: গীতা আমার তোয়ালে কোথায়? গীতা আমার চশমা কোথায়? কই গো, আমার জুতোটা কোথায় গেল? সবেতেই গীতা, গীতা আর গীতা! গীতা ছাড়া চোখে অন্ধকার। সবংয়ের বিদায়ী বিধায়ক গীতাও জানেন, মানস যতই হিল্লি-দিল্লি করুন, ঘরে গিন্নি ছাড়া গতি নেই। মানসও বলেন, ওঁকে ছাড়া এক পা-ও চলতে পারি না।

রন্ধনে দ্রৌপদী: স্ত্রী-র হাতের সব রান্নাই প্রিয়। মাছ-মাংস সবেতেই নাকি গীতা ‘রন্ধনে দ্রৌপদী’। তবে প্রিয় মেনু বউয়ের হাতের ডাল-আলু পোস্ত। দিনভর লাল চা। তবে বিকেলের দিকে একটু চিনি দিয়ে দুধ চায়ের লোভ হয়। ইদানীং রক্তে শর্করা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেটা একদমই বারণ। তবু কখনও সখনও লোভ সামলাতে পারেন না। যদিও দুধ চা খেলেই বড্ড ‘গ্যাস’ হয়ে যায়।

সতীর পুণ্যে পতির পুণ্য: তবে শুধু ‘স্ত্রী’ গীতা নন, ‘রাজনীতিক’ গীতাকেও প্রচুর নম্বর দেন। ভোটপ্রচারে গিয়েও বলছেন, গত চার বছরে সবংয়ে গীতা কী কী করেছেন। কোথা থেকে কোথায় কত কিলোমিটার রাস্তা বা মাদুরশিল্পী থেকে পটশিল্পীদের জন্য গীতার কাজের খতিয়ান। কথায় কথায় ‘অনুপ্রেরণা’-র উল্লেখ ভুলছেন না। গীতাকে অতীতে সে ভাবে রাজনীতির ময়দানে না দেখা গেলেও মানসের বক্তব্য, গীতা তাঁর ৪৯ বছরের ‘রাজনৈতিক সঙ্গী’। বিধায়ক সতীর গত চার বছরে কাজের পুণ্যিতেই ভোটপ্রার্থী পতির পুণ্য।

হাফ সেঞ্চুরি: আর মাত্র একটা বছরের অপেক্ষা। ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ বিয়ে করেছিলেন। ২০২২-এর মার্চে তার সুবর্ণজয়ন্তী। তবে কিনা ১৯৭২ সালের মার্চেও ভোট ছিল। মধুচন্দ্রিমায় যাওয়াই হয়নি। ২১ বছর বয়সে বাবার কথায় বিয়ে করেছিলেন। ‘হনিমুন’ শব্দের অর্থও বুঝতেন না। আর ষোড়শী গীতা তখন তো সবে ফ্রক ছেড়ে শাড়িতে।

কেলে-কপাল: রাজ্য-রাজনীতিতে মানসের কপাল কেলে, তেমনটা কেউ বলতে পারবে না। সব জমানাতেই তাঁর উপস্থিতি প্রকট। কিন্তু কা করবেন! নামের সঙ্গে জুড়ে আছে ‘কেলেঘাই-কপালেশ্বরী’। বিধানসভা এবং সংসদে দুই নদীর নাম করে করে গলা ফাটিয়ে ফেলেছেন। মানসের দাবি, সেই কারণেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু নাকি তাঁকে ‘মিস্টার কেলেঘাই-কপালেশ্বরী’ বলে ডাকতেন। ভোটপ্রচারেও ওই দুই নদীর সংস্কারে তিনি কী করেছেন, কী করতে চেয়েছেন আর কী করবেন, নিরন্তর সেটা বলে চলেছেন। সেই সঙ্গে ‘কেন্দ্র টাকা আটকে রেখেছে’ অভিযোগ তো আছেই। এবার সেই আক্রমণে জুড়েছে শুভেন্দু অধিকারী ও রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। কারণ, দু’জনেই একদা রাজ্যের সেচমন্ত্রী ছিলেন।

বাসন্তী রং দিয়া: সাদা ধুতির সঙ্গে বাসন্তী রংয়ের পাঞ্জাবিতে সদা উজ্জ্বল। রাজনীতিকরা সাধারণত সাদা পাঞ্জাবিতেই স্বচ্ছন্দ। কিন্তু কে জানে কেন, মানসের পছন্দ চড়া হলুদ রং। বিধানসভা থেকে রাজনীতির মঞ্চ— সর্বত্র তিনি অনায়াসে দূর থেকে দেখলে মনে হয় আস্ত একটি সূর্যমুখী ফুলই হেঁটে আসছে যেন।

অ-মঙ্গলকোট: মঙ্গলে অমঙ্গল! বর্ধমানের মঙ্গলকোটে হাঁটু পর্যন্ত ধুতি তুলে আলপথ ধরে ছুটছেন মানস। পিছনে ধাবমান সিপিএম জনতা। সরাসরি সম্প্রচারে সে দৃশ্য দেখছে গোটা রাজ্য। সারা দেশ। অনেকে মশকরা করেছিলেন। কিন্তু কংগ্রেসকর্মীদের কাছে সিপিএম-এর ‘সন্ত্রাস’ অভিযোগের প্রতীক হয়ে উঠেছিল মানসের ওই আল ধরে দৌড়।৷ মানস এখনও সেই আতঙ্ক ভোলেননি। এখনও দাবি করেন, সে দিন তাঁকে মেরে ফেলারই চেষ্টা হয়েছিল। তার পরে অবশ্য কেলেঘাই-কপালেশ্বরী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। সেই সিপিএম-কে পাশে নিয়ে ২০১৬ সালে মমতার বিরুদ্ধে গিয়ে জোট মন্ত্রিসভা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন মানস। তবে এখন আর ওই পর্বের উল্লেখ চান না। আবার এড়িয়েও যেতে চান না। বলেন, ‘‘সবই করেছি দলের নির্দেশে।’’ তবে কিনা, মানস এমনই। যখন যেমন, তখন তেমন। যেখানে যেমন, সেখানে তেমন। তাই ২০১৬ সালে তুমুল মমতা বিরোধিতার পরেও ২০১৭ সালে মমতা-স্পর্শেই রাজ্যসভায় গিয়েছেন।

সূর্য-আলিঙ্গন: ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভোট-বাংলার ‘জোট-চিত্র’ হয়ে উঠেছিল নারায়ণগড়ের সিপিএম প্রার্থী সূর্যকান্ত মিশ্রকে মানসের সুদৃঢ় আলিঙ্গন। মানস অবশ্য আবরও বলছেন, ‘‘যখন যেটা দল করতে বলে, তখন অনুগত সৈনিকের মতো সেটাই করি।’’ কে কাকে জড়িয়ে ধরেছিল, তা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। কারণ, নরেন্দ্র মোদীর মতো মানসও আলিঙ্গন-প্রিয়। ভ্রাতা-বন্ধু-শত্রু— কেউই তাঁর আলিঙ্গন থেকে বঞ্চিত হন না। তবে করোনাকালে নিজেকে খানিক বদলেছেন।

ভোট-ডাক্তার: পাস-করা চিকিৎসক। দক্ষ চিকিৎসকও বটে। কিন্তু রাজনীতির নেশায় পেশাটা কেলঘাইয়ের জলে ডুবে গিয়েছে। সারা বছর প্র্যাকটিসও করা হয় না। কিন্তু ভোটের সময় ডাক্তারিটা করেন। ভোটারদের নাড়ি টিপে দেখেন। বুকে স্টেথোও লাগান। কখনও কখনও নির্দেশ দেন— ‘জিভ দেখি’। ‘অ্যা করুন তো’। তামাম সবং জানে, খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখে দেওয়াটা মানস-প্রচারের অঙ্গ। চিকিৎসাশাস্ত্রে নিজেকে ‘আপডেটেড’ রাখতে নিয়ম করে আমেরিকাবাসী চিকিৎসক ছেলের সঙ্গে ভিডিয়ো কলে প্রশিক্ষণ নেন।

পশ্চাদভূমি: গ্রামের সরু রাস্তায় মোটরবাইকই সেরা বাহন মনে করেন। আগে নিজে মোটরবাইক চালিয়ে ঘুরতেন। তবে এখন মাথায় দুশো চিন্তা। বাইক চালানোর মতো একাগ্রতা রাখতে পারেন না। তাই পিছনের পিলিয়ন বেছে নিয়েছেন। তবে তাতেও সমস্যা। গ্রামের রাস্তায় বাইকে চেপে ঘুরে ঘুরে কোমরে ব্যথা! তবে মুখের হাসিটি সমান চওড়া।

বড় আদরের ছোট বোন: তৃণমূলে খুব বেশি দিন নয়। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবরই তাঁর কাছে ‘বড় আদরের বোন’। এখন অবশ্য তিনি নেত্রী। বিরোধী শিবিরে থাকার সময়ও মমতার প্রতি ‘ভালবাসা’ অক্ষুণ্ণ ছিল। দাবি করেন, মমতা নতুন দল গড়ার সময় সঙ্গ না দিলেও সম্পর্ক সব সময়ই ভাল ছিল।

জগাই-মাধাই: হাত ছেড়ে হাতে জোড়াফুল তুলে নিলেও তিনি ‘দলবদল’ করেননি। এমনই মনে করেন। দাবি করেন, দল না তাড়িয়ে দিলে তিনি কিছুতেই কংগ্রেস ছাড়তেন না! বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান পদ নিয়ে তাঁর বিষয়ে দলের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল বলে এখনও মনে করেন। তাঁর দলত্যাগের (তিনি বলেন, তাঁকে তাড়ানোর) পিছনে জগাই-মাধাইয়ের হাত ছিল। জগাই-মাধাই। আব্দুল মান্নান-অধীররঞ্জন চৌধুরি।

মামলা হামলা: সকলে বলে, খুনের মামলায় নাম জড়ানোর পরে রক্ষা পেতেই জোড়াফুলের শরণ নিয়েছিলেন। ভোট প্রচারেও সেটা বারবার বলছে বিজেপি। তবে মানস বলছেন— বোগাস!

তথ্য: পিনাকপাণি ঘোষ, রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE